ইউকে শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
হেডলাইন

সিলেট নার্সিং কলেজের হোস্টেল যেন কারাগার

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :কোনো অপরাধ করে কারাগারে গেলে প্রথম দিন আমদানিতে রাখা হয় আসামিদের। এই আমদানিতে এক রুমে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন গাদাগাদি করে থাকেন। ঠিক একই পন্থায় চলে সিলেট নার্সিং কলেজের আবাসিক হোস্টেল। নার্সিংয়ের প্রথম বর্ষে যারা আসেন, তাদের হোস্টেলের হলরুমে রাখা হয়। যেখানে কোনো খাটের ব্যবস্থা নেই। সবাইকে ফ্লোরে বিছানা পেতে থাকতে হয়। ২০ থেকে ২৫ জন ধারণক্ষমতার একটি রুমে রাখা হয় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রীকে।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই আবাসন সমস্যার কোনো সমাধান করছেন না কলেজ ও হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। তাই কিছুদিন পরপরই পর্যাপ্ত রুমের দাবিতে ছাত্রীরা ছোটখাটো আন্দোলন করেন। তখন নতুন ৬ তলা ভবনে ছাত্রীদের শিফট করার আশ্বাস, পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয়সহ নানাভাবে তাদের আবার ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মে) আবাসনের এই সমস্যায় অতিষ্ঠ হয়ে কলেজে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে রুমের দাবি করেন বেশ কয়েকজন ছাত্রী।

হোস্টেলে অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যাচের বেশ কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএসসি ১৩ ব্যাচের ৪৪ জন ছাত্রী সিনিয়রদের সঙ্গে রুমে উঠছেন। কিন্তু ২৪ জন ছাত্রী সিনিয়রদের সঙ্গে গাদাগাদি করে রুমে থাকবেন না। তাই তারা হলরুমে আছেন। এদিকে আবার প্রতি রুমে একজন করে নতুন ব্যাচের জুনিয়র দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে মিডওয়াইফারি পুরাতন প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা এখনো হলরুমে। তাদের সিনিয়রদের পরীক্ষা শেষ হয়নি। তাই তারা রুম পায়নি।

তাই বিভিন্ন ব্যাচের প্রায় ৪৫ জন ছাত্রী বৃহস্পতিবার (২৩ মে) কলেজ এ গিয়ে আন্দোলন করেন রুমের দাবিতে। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ বেলা ২টা ৪০ মিনিটে নির্দেশ দেয় চারজনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন রুমে সব ব্যাচমেট মিলে ৮ জন করে থাকার। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত না মেনে রুমে রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রীরা। এরপর হোস্টেলে আসা শিক্ষকরা তালা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে ছাত্রীদের গালাগালি করেন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশ মানার জন্য হোস্টেলে পুলিশ নিয়ে আসেন। তারপরও কেউ হোস্টেল কর্তৃপক্ষের এই অমানবিক নির্দেশ মানেননি। সবার দাবি ছিল নতুন হোস্টেল।

এদিকে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের এই নির্দেশ মানাতে না পেরে বিকেলে সবাইকে হল ছাড়ার নোটিশ দেন সিলেট নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম। নোটিশে বলা হয়, ‘সিলেট নার্সিং কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের প্রশাসনিক কারণে ২৩ মে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সব আবাসিক হোস্টেল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হলো। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।’

এদিকে হোস্টেল বন্ধের নোটিশ দিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে হোস্টেলের বাবুর্চিসহ সব স্টাফকে সরিয়ে নেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে রাতে ছাত্রীরা নিজেরা রান্না করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট নার্সিং কলেজের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত এক ছাত্রী বলেন, ‘আমরা এখানে ১৯৭১ সালের মতো দিনযাপন করছি। সারাদিন হোস্টেলে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। নিজেদের রুমে অতিরিক্ত ছাত্রী নেবে না। তাই সিনিয়র আপুরা রুমে তালা দিয়ে দেন। আবার কলেজের স্যার-ম্যামরা এসে তালা ভেঙে রুমে প্রবেশ করেন। আমাদের শিক্ষকরা আবার হোস্টেলে পুলিশ নিয়ে আসেন। এতকিছুর পর আমরা ছাত্রীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের অমানবিক সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় হোস্টেল ত্যাগের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ। কিন্তু এই শর্ট নোটিশে রাতে আমরা কীভাবে হোস্টেল ত্যাগ করব? আমরা কোনো কারণ ছাড়া কেন হোস্টেল ত্যাগ করব?’

পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিংয়ের আরেক ছাত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয় আমরা জেলে আছি। কলেজ কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তাদের অমানবিক সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। চারজনের থাকার রুমে আটজন থাকার জন্য তারা জোর জবরদস্তি করছেন। তারা হোস্টেলে পুলিশ কীভাবে আনলেন। আমরা তো কাউকে খুন করিনি। আমাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু শুধু চেয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রীদের হোস্টেলের জন্য একটি ছয়তলা ভবন রেডি আছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেখানে ছাত্রীদের উঠতে দিচ্ছেন না। কিন্তু বারবার এই আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ছয়তলা বিল্ডিংয়ে রুম দেওয়া হবে তখন থাকার সমস্যা হবে না। কিন্তু এই আশ্বাস তারা দীর্ঘ ৫-৬ বছর ধরে দিচ্ছেন। আমাদের আগের সিনিয়র আপুরাও এই আশ্বাসেরে ফাঁদে পরে কোর্স শেষ করে চলে গেছেন। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রাপ্যটা বুঝিয়ে না দিয়ে উল্টো শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করছেন।’

জানা যায়, সিলেট নার্সিং কলেজ হোস্টেলে আছেন কলেজের পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন পাবলিক হেলথ, পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং, বিএসসি নার্সিং কোর্স ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রী।

হোস্টেলে অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোস্টেলের এই আবাসন সমস্যা চলছে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে। দায়িত্বশীলরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন বিল্ডিংয়ে ছাত্রীদের দেই-দিচ্ছি বলে আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না। হোস্টেলের চারতলা ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় তিনটি হলরুম আছে। সেগুলোতে নার্সিংয়ের ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা থাকে। মিডওয়াইফারি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা দ্বিতীয় তলার হলরুমে থাকে, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার হলরুমে থাকে বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা। ভবনের প্রথম তলায় রান্নাঘর ও খাবার ঘরের পাশাপাশি কয়েকটি থাকার কক্ষও রয়েছে। দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়ও থাকার কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোতে এই চার প্রোগ্রামের প্রথম বর্ষ (পুরাতন), দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রীরা থাকেন। প্রতিটি কক্ষে চারজন করে থাকার ধারণক্ষমতা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এসব কক্ষে ছয়জন ছাত্রী গাদাগাদি করে থাকছেন। এই ছয়জনের মধ্যে চারজন সিনিয়র, একজন পুরাতন প্রথম বর্ষের ছাত্রী বেডে থাকছেন এবং হলরুমে জায়গা না হওয়ার সব রুমে ফ্লোরে একটা জুনিয়রকে (নতুন প্রথম বর্ষ) থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে এসেছি। হোস্টেল বন্ধের নোটিশ দেওয়া হলেও মূলত হোস্টেল বন্ধ না। রাতে বেশিরভাগ মেয়েই হোস্টেলে ছিল। ছাত্রীরা এখনো হোস্টেলে আছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া চলছে। যিনি হোস্টেলের দায়িত্বে আছেন তাকে বলে দিয়েছি ছাত্রীরা থাকবে, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে। আমাদের দেওয়া নোটিশটি আমরা বাতিল করব।’

আবাসন সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, “তাদের জন্য নতুন একটি বিল্ডিং হয়েছে। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের বুঝিয়ে দিলে আমরা ছাত্রীদের সেখানে শিফট করব। এ বিষয়ে আমরা তাদের বুঝিয়েছি। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাদের সঙ্গে আমার টাইম টু টাইম কথা হচ্ছে। এই বিল্ডিং বুঝে পেতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হেড অফিসের পরিচালক (শিক্ষা) ও ডিজি স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, ‘আপনারা ২৫ মে পর্যন্ত ধৈর্য ধরেন আমরা আসতেছি। আপাতত আপনি লোকাল ম্যানেজমেন্টে তাদের রাখেন। আমরা ২৫ তারিখের পর এসে সব সমাধান করে দেব।’ আমি এ বিষয়ে আমার শিক্ষক ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনা করছি। আশা করছি দ্রুত এর সমাধান হবে।”

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com