ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : একটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী পর্যায়ে রয়েছে, তা সহজেই বুঝে নেওয়া যায় সেই রাষ্ট্রে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম ক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে। সংবাদমাধ্যম যেহেতু সর্বস্তরের মানুষের মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রাপ্তির সবচেয়ে বিস্তৃত এবং বলিষ্ঠ মাধ্যম, তাই এর সূচকে একটি রাষ্ট্রের জনগণ কতটা নিরাপদ ও সুশাসনের আওতায় আছে, তা যাচাই করা যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অতীতের পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে শুধু অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় যে ক’টি সাংবাদিক নির্যাতন এবং সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, এর পরিসংখ্যান রীতিমতো ভীতিকর। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ২১ আগস্ট রাতে, রাজধানীর তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকায়। যেখানে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় স্থানীয় একদল উঠতি বয়সের কিশোর একুশে টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক সাব্বির আহমেদ ও তাঁর ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমনের ওপর পাশবিক হামলা চালায়। সর্বশেষ তথ্যমতে, এ ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অথচ এই হামলাকারী কারা, তা ওই এলাকার অনেকেই জানেন। এমনকি পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিও তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
এই একটিই নয়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে শুধু আগস্ট মাসেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকদের ওপর হামলার এমন বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। ২ আগস্ট রাজধানীর তালতলায় ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মেডিকেলের যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ সংগ্রহে গেলে ডিবিসি নিউজের দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়। ক্যামেরা ভাঙচুর ও ফুটেজ ডিলিট করে দেয় হামলাকারীরা। ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কাওছার ভূঁইয়া ও তাঁর সহযোগীরা এ হামলা চালায়।
১২ আগস্ট সংবাদ সংগ্রহ শেষে ফেরার পথে যমুনা টিভির লালমনিরহাট প্রতিনিধি আনিসুর রহমান লাডলা, প্রথম আলোর আব্দুর রব সুজন, এখন টেলিভিশনের মাহফুজুল ইসলাম বকুল এবং যমুনা টিভির ক্যামেরাপারসন আহসানের ওপর হামলা চালান লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুর রহমান মণ্ডলের ছেলে সুলতান মণ্ডল, তাঁর সহযোগী সাহেব আলীসহ একদল দুর্বৃত্ত। ১৪ আগস্ট সাভার উপজেলা পরিষদ চত্বরে সাংবাদিক সোহেল রানার ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ পাভেল আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে যাওয়ার পথে গাড়ির হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে আইনজীবীর হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সদস্য, যমুনা টিভির রিপোর্টার আল আমিন সিকদার ও ক্যামেরাপারসন আসাদুজ্জামান লিমন। এ ছাড়া ১০ আগস্ট বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত টিআইবির এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত অন্তত ১১৯ জন সাংবাদিক নানামুখী হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ৩৮ জন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার এবং ১৯ জন প্রকাশিত সংবাদের দায়ে মামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এই কাগজের পরিসংখ্যানের বাইরেও বহু সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে, যা প্রতিনিয়তই ঘটছে।
প্রতিবার এমন ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সংবাদকর্মী ও সাধারণ মানুষ চরম প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ জানান। করা হয় মামলা। অনেক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তবুও কেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা থামছে না, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
অনেকের ধারণা, সাংবাদিক সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারা বিচ্ছিন্নভাবে এসব ঘটনার ক্ষেত্রে সরব হলেও সামগ্রিকভাবে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রতিরোধে এবং সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে।
এই সংকটের গভীরতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যবস্থার কাছে আজ একটি প্রশ্ন না করলেই নয়- একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যদি মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চাকে প্রভাবিত করার মতো আইন প্রণয়ন করা যায়, তবে সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইনের বিধান প্রণয়ন নয় কেন? পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সংশ্নিষ্টদের প্রতি অনুরোধ, এই সংকট উত্তরণে গণমাধ্যমকর্মীদের অভিভাবক হিসেবে রাজনৈতিক মেরূকরণের ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করুন। দেশে সাংবাদিক নেতার চেয়ে সাংবাদিকের নেতার প্রয়োজন খুব বেশি। জাতির বিবেকের এমন বিবর্ণ দশা হলে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকরা ব্যর্থ হবেন। সেটি হলে নতুন প্রজন্ম এই পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, যা আগামীর বাংলাদেশের জন্য মোটেই শুভ হবে না। চতুর্থ বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাংবাদিক সমাজ যদি রাজনৈতিক চাপ, আইনি প্রতিবন্ধকতা, হামলা, মামলা আর নির্যাতনে কোণঠাসা থাকে, তবে এর চেয়ে বড় লজ্জা আর হয় না।