ইউকে বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
হেডলাইন

শাবিপ্রবি’র ছাত্র-শিক্ষক অনাস্থা: দায়ী কে?

শাবিপ্রবি’র ছাত্র-শিক্ষক অনাস্থা: দায়ী কে?

আফসানা সালাম: আজ প্রায় তিনদিন শাবিপ্রবি’র শিক্ষার্থীরা অনশনে। ঘন শীতের রাতে একের পর এক এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে এলাকায় বাস করা সব মনূষ্য-হৃদয় আশংকিত; বিবেকহীন প্রাণীদের হৃদয়ের কথা জানার সুযোগ নেই।
অনশনকারীরা একে একে অবস্থা খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে যাচ্ছে, ফিরেও আসছে এক-দু’জন। দূর্বল শরীর তবু অনশন চালিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় তাদের চোখে-মুখে।
সেখানে কারো আরাম করে বসা বা দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কোনরকম চাঁদোয়া টাঙিয়ে ঠান্ডা মাটির উপর শুয়ে আছে অনশনকারীরা। তাদের পাশে আছে তাদের উদ্বিগ্ন সহপাঠীরা এই হাড়কাঁপানো শীতে। সাংবাদিকরা আসছেন, খবর কাভার করে ফিরে যাচ্ছেন বা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছেন। আর আসছেন আলোচনায় আশাবাদী শিক্ষক (ও প্রশাসক) প্রতিনিধিগণ। তারা “একবার না পারিলে দেখো শতবার” এ প্রবলভাবে বিশ্বাসী। তাই ভিসি’র পদত্যাগ ছাড়া আর কোন বিকল্প কেউ এই মুহূর্তে শুনতে প্রস্তুত না হলেও তারা বার বার বিভিন্নভাবে একই বক্তব্য তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীদ্র কাছে। অধ্যাবসায়ী এসব শিক্ষকেরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে, একটি তদন্তকমিটি যেহেতু হয়েছে; ছাত্রদের “উচিত”-
১. তদন্তকমিটির রিপোর্ট আসা পর্যন্ত তাদের “এক দফা এক দাবী” থামিয়ে অপেক্ষা করা, ( যদিও বাংলাদেশের যেকোন তদন্তকমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখাটা খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়)
২. রিপোর্ট আসার পরে কে দোষী সাব্যস্ত হয় তা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া “উচিত” (যেহেতু তারা মনে করছেন, ছাত্ররা এখনো জানেনা ঠিক কার দোষে কি ঘটেছে )
৩. তদন্তে পাওয়া দোষী ব্যক্তিবর্গের বিচার হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা ( এধরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে আন্দোলন প্রশমিত করে ফেললে আর বছর চারেক পর এই ব্যাচগুলোর সবাই বেরিয়ে গেলেই এ বিষয় মাটিচাপা পড়ে যাবে)
৪. দোষী ব্যক্তিদের বিচারে যে শাস্তি দেয়া হয় তা কার্যকর করা হয় কিনা তা দেখা ( এই শিক্ষার্থীদের ছেলে-মেয়েরা তাদের বর্তমান বয়সী হওয়া পর্যন্ত সেই আশায় বসে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা)
৫. শিক্ষামন্ত্রী বা তার প্রতিনিধি অথবা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার “সমাধান” বের করে আনা ( যেহেতু তারা মনে করেন যে, শিক্ষার্থীদের উপর গুলি-বোমা হামলা ও মামলার পরে তাদের তোলা একদফা দাবীর পরও এই উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়াই সমস্যার সমাধানের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের এগোনোর সুযোগ আছে)
এবং
৬. বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, তাই আদেশ মেনে চাঁদোয়া-কম্বল গুটিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া ( সেক্ষেত্রে ছাত্রদের তারা অনলাইনে বাকী আন্দোলন করার সদয় সুযোগ দেবেন কিনা বা আরো আরো আলোচনা করবেন কিনা সে পরিকল্পনা এখনো জানা যায়নি)।
পাঠক, আসুন ফিরে তাকাই চার-পাঁচদিন আগে ঘোষিত সেই তদন্ত কমিটির কাজ কেমন এগিয়েছে।
“সর্বরোগের মহৌষধ” নিহিত থাকা যে তদন্তকমিটির কথা বারবার বিভিন্ন মিডিয়ায় শাবি ভিসি বা শিক্ষকগণের একাংশ বলছেন, তার কথিত প্রধান অধ্যাপক রাশেদ তালুকদার আজ সাংবাদিকদের কমিটির তদন্ত কাজের অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, তিনি কমিটি “হওয়ার কথা শুনেছেন, কোন আনুষ্ঠানিক চিঠি পাননি তাই কোন কাজও শুরু করতে পারেননি”।
“এ কি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!” কমিটি গঠনের ঘোষনার পাঁচদিন পর জাতি এই কথা জানতে পারলো! অথচ আজ সন্ধ্যায় শাবি’র আরেক শিক্ষককে টকশো তে উত্তেজিত ভঙ্গীতে বারবার উক্ত তদন্তকমিটির রিপোর্ট “তিনদিনের মধ্যে” পাওয়ার দাবী করতে দেখা গেল! তাদের তদন্ত কাজের গতি ও এই দাবীর মধ্যে কোন মিল বা সমন্বয় পাওয়া গেলো কি?
যাই হোক, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বয়সে নবীন। তাই হয়তো অনেককেই তাদের আবেগ নিয়ে কথা বলতে দেখেছি, ছাত্র-শিক্ষক মুখামুখি পরিস্থিতির জন্যে ও ওদের আবেগকে দায়ী করতে দেখছি। নিজেদের কষ্টকর সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে শেষ পর্যায়ে কেঁদে ফেলেছে সাদিয়া নামের মেয়েটি আর তক্ষুনি টকশোতে থাকা তার “অভিভাবকতূল্য” শিক্ষক যখন মুখ খিঁচিয়ে উঠে বলেন, “আমরাও কাঁদতে পারি!” – উপস্থিত সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সচিব, উপস্থাপক বা দর্শক কারোই বুঝতে আর বাকী থাকে না যে কোন পক্ষ টি নিজের উচ্চস্থান থেকে নেমে এসে মুখামুখি অবস্থান নিয়েছেন। যদিও চিরদিনই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখার বিষয়ে বয়সে, বিদ্যায় ও অভিজ্ঞতায় বড় শিক্ষক পক্ষেরই দায়িত্ব বেশি।
মননশীল মানুষমাত্রই চিন্তা করা প্রয়োজন যে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শাবি’র শিক্ষক তথা প্রশাসকদের ধাপে ধাপে করা নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গুলো আজকের এই মুখামুখি অবস্থানের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে কি না-
১. প্রভোস্ট কর্তৃক আলোচনার দাবীর বদলে কটুকথা শুনিয়ে ছাত্রীদের আন্দোলনে ঠেলে দেয়া,
২. ভিসি কর্তৃক দাবী শুনতে না চেয়ে গুলি-বোমা মেরে আহত করা,
৩. উল্টো শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া,
৪. আন্দোলন ধামাচাপা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া,
৫. কতিপয় শিক্ষক রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং
৬. ঘটনা পরম্পরা নিয়ে ক্রমাগত বিশিববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহলের সমন্বয়হীন তথ্যপ্রদান ও ক্ষেত্র বিশেষে মিথ্যা ও চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া।
সবশেষে বলবো- তদন্তকমিটি বা আলোচনার এই মুলা ঝুলিয়ে, কালক্ষেপণ করে, চলমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে, শিক্ষার্থীদের জীবন ও শিক্ষাজীবন বিপন্ন করে, শুধুমাত্র একজন গোঁয়ার ব্যক্তির ইগো ও পদরক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে প্রশাসন ও সরকারের কি লাভ জানিনা; দেশজুড়েই জনমানসে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রতি মোহভঙ্গ ও এইরূপ মানসিকতাধারী শিক্ষকদের প্রতি অসম্মান ঘনীভূত হলেও কার লাভ হয় – তা আমার ধারনার বাইরে।
শিক্ষার্থীদের এই “নো পয়েন্ট অফ রিটার্ন” এ ঠেলে দেয়ার সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ একটিই। সকলের মধ্যে শুভবোধের উন্মেষ আশা করি। আশা করি, অন্য সকল সংকটের মতো এক্ষেত্রেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা ও সময়োচিত পদক্ষেপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অচলাবস্থা নিরসন করবেন আর দক্ষ, আন্তরিক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকদের নেতৃত্বে আবারো ছাত্র-শিক্ষক পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানের পরিবেশ ফিরে পাবে শাবিপ্রবি।

আফসানা সালাম। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি
বার্মিংহাম,২২ জানুয়ারি, ২০২২
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব। ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ এর নয়। - সম্পাদক

সর্বশেষ সংবাদ