ইউকে রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
হেডলাইন

মেকআপ আর্টিস্ট আহমেদ আলী, এ জগতেই ৪৬ বছর

মেকআপ আর্টিস্ট আহমেদ আলী, এ জগতেই ৪৬ বছর

মেকআপ আর্টিস্ট আহমেদ আলী, এ জগতেই ৪৬ বছর

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : আহমেদ আলী। যিনি ৪৬ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে। এফডিসির আঙিনা থেকে শুরু করেছিলেন। এখন কাজ করছেন টিভি চ্যানেলে। সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন বেসরকারী টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে। যার ওস্তাদ ছিলেন মরহুম সৈকত আলী। মেকআপ আর্টিস্ট এর হাতেকড়ি যার হাত ধরেই। এসিস্ট্যান্ট হিসেবে ৭-৮ বছর কাজ শেখা। তারপর ইন্ডিভিজুয়াল মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন।

১৯৭৫ সাল থেকে কাজ শুরু করা আহমেদ আলী একক মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে প্রায় ২০০টিরও অধিক সিনেমাতে কাজ করেছেন। তখনকার সময় এফডিসির আঙিনা জমজমাট থাকতো। চলচ্চিত্রের বাজারও ছিল অনেক ভাল। প্রায় ৪০০/৪৫০ সিনেমা হল ছিল বাংলাদেশে। ঢাকা শহরেই অনেক সিনেমা হল ছিল। সেই সাথে বিভাগীয় শহরগুলোতেও বড় বড় সিনেমা হল ছিল অনেক। ভাল ভাল সিনেমা হত। যার কারণে মানুষের মধ্যে হলে যাওয়ার আগ্রহও ছিল অন্যরকম।

অনেক ভাল ভাল সিনেমাতে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন আহমেদ আলী। কাজ শুরুর সময়ে শেখ নজরুল ইসলামের নদের চাঁদ, আজিজ উদ্দিনের ঘরনী, এতিম, সারেং বউ, গোলাপি এখন ট্রেনে’র মত ভাল মানের সিনেমা তৈরি হয়েছিল। যার মধ্যে- এতিম, ঘরনী, লোভ লালসা, প্রতিহিংসা, ভালবাসার ঘর সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি।

তখনকার সময়ে সিনেমার সুপারস্টার নায়ক-নায়িকাদের মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন আহমেদ আলী। যাদের মধ্যে রাজ্জাক, আলমগীর, ওয়াসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাবানা, ববিতা, কবরী, অলিভিয়া, রোজিনার মত নায়ক-নায়িকাদের মেকআপ করানোর মধ্য দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরবর্তীতে মান্না, সালমান শাহ, চম্পা, দিতি, ফেরদৌস, মৌসুমী, ওমরসানী, শাবনূর এর মত নায়ক-নায়িকাদের মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

সিনেমা জগতে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে শেষ কাজ করেছেন ২০০৭ সালে। ‘নীল আঁচল’, ‘পাওয়ার’ এ দুটি সিনেমা ছিল মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে সিনেমা জগতে আহমেদ আলীর শেষ কাজ। তারপর বেসরকারি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে চাকরী শুরু করেন। যেখানে শুরু থেকেই একজন সিনিয়র মেকাপ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। যে চ্যানেলের মেকআপ হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্ট আহমেদ আলীর মতে- ‘আমাদের দেশে মেকআপ আর্টিস্টদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ এখনও হয়ে উঠেনি। সেই সাথে এ বিষয়ে ট্রেনিং নেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। আমাদের দেশে এ সেক্টরে মানুষ কাজ শেখে ওস্তাদের হাত ধরে। সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে। ৫ থেকে ১০ বছর সহকারী হিসেবে কাজ করার পর একজন মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে উঠে। জেনারেশন টু জেনারেশন এভাবেই হয়ে আসছে। আমরাও এভাবে কাজ শিখেছি। দীর্ঘদিন ওস্তাদের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে করে মেকআপ আর্টিস্ট হয়েছি।’

বর্তমানে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ কেমন জানতে চাইলে সিনিয়র এ মেকআপ আর্টিস্ট নিজের মন্তব্যে বলেন- ‘বর্তমান সিচুয়েশনে সব সেক্টরের অবস্থায় খারাপ যাচ্ছে। আর শুধু মেকআপ আর্টিস্ট নিয়ে বলতে গেলে বলবো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, নাটক ও টিভি চ্যানেলে মেকআপ আর্টিস্টদের কাজ করার সুযোগ থাকলেও আগের মত অবস্থা এখন নেই। কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে। তাছাড়া আমাদের সিনেমা তো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে একটা বিল পাস করেছেন। দেখা যাক এ নিয়ে কোন উপকার হয় কিনা।’

তিনি বলেন- ‘এখন তো চলচ্চিত্র আগের মত হয় না। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ভেঙে ফেলছে, মার্কেট করে ফেলছে। সিনেমা চালাবে কোথায়? মানুষ সিনেমা হলে যায় না। সেজন্য বলতে হয় এই সেক্টরে কোন ভবিষ্যৎ এখন নেই।’

আহমেদ আলী বলেন- বর্তমানে টিভি চ্যানেলে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ পাওয়াটা কিন্তু এত সহজ নয়। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় সেখানের সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্ট, এসিস্ট্যান্ট মেকআপআর্টিস্টসহ হালকা-পাতলা কাজ জানা অনেকেই টিভি চ্যানেলে চাকরী করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেজন্য টিভি চ্যানেলে চাকরী পাওয়াটা কঠিন। তাছাড়া সহজে কেউ চাকরী ছাড়তেও চায় না। যার কারণে পদ খালি হওয়ারও সুযোগ কম।

বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এই সেক্টরে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে সিনিয়র এই মেকআপ আর্টিস্টের মন্তব্য- ‘অনেকে পেটের দায়ে এই প্রফেসনে আসছে। আবার অনেকে চ্যানেলে চাকরী করবে সেই আগ্রহ নিয়ে আসছে। আর মূল কথা হলো, কাজ জানা না থাকলে এখানে তো চাকরীই হবে না। কোন না কোনভাবে কাজ শিখতে হবে। একদম ফ্রেস ছেলেমেয়েদের এখানে কাজের কোন সুযোগ নেই। যেমন, পার্লারে কাজ জানা মেয়েরাও কিন্তু কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। যদিও পার্লারের মেকআপ আর টিভি চ্যানেলের মেকাপের মধ্যেও অনেক তফাৎ আছে। পার্লারের কাজ এক ধরণের আর টিভি চ্যানেলের কাজ আরেক ধরণের। পার্লারে তো অধিকাংশ সময় বউ সাজাতে হয়। চ্যানেলে তো আর বউ সাজাতে হয় না। এখানে প্রেজেন্টারদের সাজাতে হয়। কিন্তু মেকাপ সম্পর্কে ধারণা থাকায় পার্লারে কাজ করা মেয়েরা আস্তে আস্তে চ্যানেলের কাজ শিখে নিতে পারে। চ্যানেলে কাজ করা মেকআপ আর্টিস্টদের দেখে দেখে তারা শিখে নিতে পারে। তাছাড়া আমাদের মত সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্টদের দায়িত্ব থাকে তাদেরকে চ্যানেলের কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, শিখিয়ে দেওয়া।’

একজন মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে সিনেমা জগত থেকে টেলিভিশনের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘সিনেমা জগত আর চ্যানেলে কাজের মধ্যে অনেক তফাৎ থাকে। প্রথমত বলবো, সিনেমা জগতের কাজে অনেক এনজয় হয়। চাওয়া, পাওয়া, ভালবাসা, আমোদ, ফুর্তি, খাওয়া দাওয়া সবকিছু মিলিয়ে এনজয়েবল। আর চ্যানেলে তো একটা চাকরী জীবন। যারা চাকরী করেন তারা চাকরী জীবনটা বুঝতে পারবেন। চাকরী জীবনটা আসলে একটি ছকের ভেতরে আটকা। সময় মতো অফিসে যেতে হবে। আমার উপরে স্যার আছে। স্যারের উপরে স্যার, ওই স্যারের উপরে স্যার আছে। মানে অফিসারের উপরে অফিসার, অফিসারের উপর অফিসার। অফিসিয়ালি কাজ বলতে যা হয় আরকি। তফাৎটা এখানেই। এখানে আপনাকে নিয়মনীতি সব মেনে চলতে হবে। এক কথায়, অন্যান্য সেক্টরে চাকরী জীবনটা যেরকম হয়, এই সেক্টরের চাকরীটাও সেরকম হয়ে থাকে।’

একটি টিভি চ্যানেলে মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু জানতে চাইলে সিনিয়র এই মেকআপ আর্টিস্ট বলেন- টিভি চ্যানেল যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকেই মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজন হয়েছে। চ্যানেল চালাতে হলে মেকআপ আর্টিস্ট লাগবেই। মেকআপ আর্টিস্ট ছাড়া চ্যানেল চলবে না। যেমন- যারা নিউজ পড়বে তাদেরকে মেকআপ দিতেই হবে। মেকআপ না দিলে ক্যামেরায় ফেইস ভাল আসবে না। ক্যামেরার সামনে যেতে হলে মেকআপ থাকতেই হবে। সবচেয়ে কম মেকআপ লাগে টক-শোতে। কিন্তু তারপরও মেকআপ করতে হয়। করতে হবেই।

তার মতে- ক্যামেরার এঙ্গেল আছে, লাইট আছে। মেকআপ না নিলে লাইটটা ঠিকমতো কাজ করবে না, ক্যামেরায় ফেইসটা ভাল আসবে না। এগুলোর অনেক ক্লাস আছে। যার জন্য মেকআপের গুরুত্বটা অনেক। তাই, কম হোক বেশি হোক একটা চ্যানেলে মেকআপ আর্টিস্ট লাগবেই। চ্যানেল যখন থেকে চালু হয়েছে তখন থেকেই চ্যানেলও মেকআপ আর্টিস্টের চাকরীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব মেকআপ আর্টিস্টরা কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গিয়ে চাকরী করছে। সেজন্য বলতে হয়, টিভি চ্যানেল বাড়ায় মেকআপ আর্টিস্টদের কর্মসংস্থানের সুযোগটাও বেড়েছে।

মেকআপ আর্টিস্ট আহমেদ আলীর সাথে কথা বলে জানা যায়, একটা টিভি চ্যানেলে কমপক্ষে হলেও ৭/৮ জন মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজন হয়। এর কমে হয় না। একটা টিভি চ্যানেলে ছেলে ও মেয়ে উভয় মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজন আছে। যেমন, নিউজ বা প্রোগ্রাম প্রেজেন্টারকে যেরকম সুন্দর ভাজ করে শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তা কিন্তু একজন ছেলেকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়েদেরকে যেভাবে সুন্দর করে চুল বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন হয় সেটার জন্যও কিন্তু মেয়েদের প্রয়োজন হয়। যদিও দু’একজন ছেলেরাও সেরকম সুন্দর করে চুল বেঁধে দিতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ এই কাজগুলো মেয়েরাই করে। যার জন্য সব টিভি চ্যানেলে মেয়ে মেকআপ আর্টিস্ট থাকে। এসব কারণে মেয়ে মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজন পড়ে।

মেকআপ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিনিয়র এই মেকআপ আর্টিস্ট বলেন- ‘মরহুম এরশাদ সাহেবকেও টকশোতে এসে মেকআপ নিতে হয়েছে। আমি উনার মেকআপ দিয়েছিলাম। ড. কামাল হোসেনকেও মেকআপ দিয়েছি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ম্যাডামকেও মেকআপ দিয়েছি। যদিও মেকআপ নিতে তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। কিছুদিন আগে টকশোতে এসেছিলেন পুলিশের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ সাহেব। উনাকেই হালকা মেকআপ দিতে হয়েছে। এটাকে বলে হালকা পাস করে দেওয়া আরকি। মূল কথা, ক্যামেরার সামনে যারাই আসেন বিভিন্ন কারণে মেকআপ নিতেই হয়।’

নতুনদের উদ্দেশ্যে বলতে গিয়ে এই মেকআপ আর্টিস্ট বলেন- ‘নতুনদের বলবো, তারা যেন প্রপার কাজ শিখে এখানে আসে। নইলে তাদেরকে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। যারা ভালভাবে কাজ শিখে না আসে তাদেরকে অনেক কথা শুনতে হয়, অপমানিত হতে হয়। এমনকি চাকরী পর্যন্ত হারাতে হয়। ২/৩ মাস কাজ করিয়ে ভাল ফিডব্যাক না পেলে তাকে চাকরী থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাই বলবো, টিভি চ্যানেলে কাজ করতে চাইলে চ্যানেলে কিভাবে মেকআপ করা হয় তা ভালভাবে শিখে এই সেক্টরে আসা উচিত।’

কাজ শেখার আগ্রহ যাদের মধ্যে আছে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- শেখার যে একেবারেই কোন জায়গা নেই তা বলবো না। আমাদের দেশে মঞ্চ নাটক হচ্ছে, থিয়েটার হচ্ছে। যদিও এখন করোনাকালীন পরিস্থিতির কারণে আপাতত বন্ধ আছে। তবে সেখান থেকে পারলে কাজ শেখা যেতে পারে। আর যদি সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ করতে পারা যায় তাহলে সেখান থেকেও কাজ শিখা যাবে। মূল কথা মেকআপ করা জেনে তারপর চ্যানেলে আসা উচিত। কাজের ধরণ আলাদা হলেও মেকআপের গোড়াপত্তনটা কিন্তু একই। সেজন্য মেকাপ করা জানতে হবে।

তিনি বলেন, কাজ যে শিখবে তার মাথায় নিতে হবে যে সে সিনেমার মেকআপ করছে, না নাটকের মেকআপ করছে, নাকি চ্যানেলের মেকআপ। কোন জায়গায় বেশি হবে, কোন জায়গায় কম হবে। কাজ জানা থাকলে হিসেবটা সে করে নিতে পারবে। এই সেক্টরে অন্যান্য জায়গায় যেভাবে ইন্টার্নি করার সুযোগ করে দেয়, চ্যানেলে কিন্তু সেই সুযোগ নেই। দিবে না। কাজ শিখতে পারলে টিভি চ্যানেলে চাকরীর সুযোগ আছে।

  • জীবন পাল। সাংবাদিক।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব। ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ এর নয়। - সম্পাদক

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com