
◽️খালেদ রাজ্জাক◽️
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ। দিশাহারা হয়ে গেছে উন্নত দেশগুলোও। বাঙলাদেশের মতো সামর্থ্যহীন দেশগুলোর জনমনে প্রবল আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। অনেকে মনে করছেন— প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা কোনো দেশের সরকারই বলছে না। সরকার-ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করছেন তারা। হতেও পারে। এ-পরিস্থিতিতে অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে একটি প্রশ্ন— প্রকৃতি কি প্রতিশোধ নিচ্ছে? প্রকৃতির সন্তান হয়ে যে-প্রকৃতিকে আমরা দিনরাত ধ্বংস করে চলেছি তাতে প্রকৃতির প্রতিশোধ নেয়াই কি সঙ্গত নয়— তাদের প্রশ্ন।
এ-প্রশ্নের সাথে উচ্চারিত হচ্ছে ম্যালথাসের নাম। টমাস রবার্ট ম্যালথাস নামের একজন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ১৯৭৮ ক্রিস্টাব্দেAn Essay on the Principle of Population নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে তিনি জনসংখ্যা বিষয়ে একটি বক্তব্য প্রদান করেন। ওই বক্তব্যটি ‘ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব’ নামে পরিচিতি পায়।
‘ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের বক্তব্য কঠিন কিছু নয়। তাঁর মতে—খাদ্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক প্রগতিতে, অর্থাৎ, খাদ্যের উৎপাদন ১ থেকে ২ হয়, ২ থেকে ৩ হয়, ৩ থেকে ৪ হয়; মানে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় অত্যন্ত ধীর গতিতে। কিন্তু জনসংখ্যাবৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক প্রগতিতে, অর্থাৎ, জনসংখ্যা ১ থেকে ২ হয়, ২ থেকে ৪ হয়, ৪ থেকে ৮ হয়, ৮ থেকে ১৬ হয়; মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে। আর এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে প্রতি ২৫ বছরে কোনো দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন বাড়তি জনসংখ্যার জন্য তৈরি হয় খাদ্যসংকট।
ম্যালথাস এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের দুটি উপায় বলে গেছেন: ১।প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা; এবং ২। প্রাকৃতিক নিরোধ।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে তিনি বলেছেন— বিলম্বে বিবাহ, কৌমার্য পালন ইত্যাদি যাতে জনসংখ্যা না বাড়ে। অর্থাৎ, তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়গুলো প্রেসক্রিপশন হিশেবে উল্লেখ করেছেন। এভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে, তাঁর মতে দেখা দেয় ‘প্রাকৃতিক নিরোধ’ যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ‘প্রাকৃতিক নিরোধ’ বলতে বন্যা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, খরা, মহামারী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃতি জনসংখ্যা কমিয়ে তার ভারসাম্য রক্ষা করবে।
এখন প্রশ্ন হলো— করোনাভাইরাসের মাধ্যমে কি প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে? ম্যালথাসের জনসংখ্যা-তত্ত্ব আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে কার্যকর হতে দেখা গেলেও ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পরে সেখানে জনসংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়ে নি। আবার খাদ্যউৎপাদনের ধীর প্রক্রিয়াকেও মানুষ বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নয়নের মাধ্যমে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করতে পেরেছে যা ম্যালথাসের তত্ত্বকে অকার্যকর প্রমাণ করে।
তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়! ধরে নিলাম ম্যালথাস ভুল। তাহলে প্রকৃতি আমাদের উপর এতোটা নিষ্ঠুর হলো কেন? একটা অণুজীবের কাছে মানবসমাজ বিপর্যস্ত— এটাকে আমরা কী দিয়ে ব্যাখ্যা করবো? প্রকৃতিকে আমরা কতোখানি জেনেছি? তার শক্তি সম্পর্কে কতোখানি জেনেছি?
আমরা বরং প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা না-করে, ভালো না-বেসে, ইচ্ছামতো ধ্বংস করে যাচ্ছি নিয়মিত। যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করছি তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রকৃতি বলেই হয়তো কিছু থাকবে না। আমরা কি কোনদিন জানতে চেয়েছি নদী কী চায়? পাহাড় কী চায়? সমুদ্র কী চায়? হাওর-বিল কী চায়? আমাদের বায়ুমণ্ডল কী চায়? নদীকে আমরা ইচ্ছামতো ভরাট করে খাল বানিয়েছি! নদীতে শিল্প-বর্জ্য ফেলতে ফেলতে তার পানিকে পুঁজ বানিয়ে ছেড়েছি! আমাদের বুড়িগঙ্গার তলদেশে শুনেছি ১০ ফুট গভীর পলিথিনের স্তর জমে রয়েছে! আমাদের শীতলক্ষ্যা দিয়ে সভ্যতার পুঁজ প্রবাহিত হচ্ছে!—কুচকুচে কালো আর দুর্গন্ধময় পানির ভার বইতে বইতে সে কি আমাদের অভিশাপ দিয়েছে? অনেক নদীর মাছ পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে গেছে, তা খাবার উপযোগী নয়। আমাদের নদীগুলো কি সৃষ্টিকর্তাকে বলেছে— আমাদের বাঁচাও? পাহাড় কি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফরিয়াদ করেছে? বায়ুমণ্ডল কি বিষাক্ত হতে হতে এখন আর নিজেই নিশ্বাস নিতে পারছে না? এসকল প্রশ্ন উত্থাপিত হলে অনেকেই ‘কবিদের ভাব’ বলে ভেংচি দিয়ে চলে যাবেন জানি। কিন্তু প্রকৃতির যে নিজস্ব একটি সত্ত্বা আছে, নিজস্ব একটি শক্তি আছে তা কেবলমাত্র দুর্যোগের সময় আমাদের মনে পড়ে! যখন স্যুনামি ধেয়ে আসে, তখন আমরা বুঝি— প্রকৃতির শক্তি কতোখানি। যখন বন্যা হয়, তখন বুঝি— প্রকৃতির কাছে আমরা কতোটা অসহায়। যখন ভূমিকম্পে তিলেতিলে গড়া নগর ধ্বংস হয়, তখন বুঝি— আমরা প্রকৃতির হাতের পুতুল ছাড়া কিছু নই।
করোনাভাইরাস কি প্রকৃতির সৈন্য? ধাওয়া করে সবাইকে ঘরবন্দী করে রেখে নিজেকে সংশোধন করছে? অনেকেই তা বলতে শুরু করেছেন। বাস্তবতাও তা-ই। দেশের পর দেশ লকডাউন হয়ে রয়েছে, বন্ধ রয়েছে কার্বন নিঃসরণ— তাতে পৃথিবীর বাতাস বিশুদ্ধ হচ্ছে দ্রুত, হয়তো নদীগুলো শিল্পবর্জ্য বন্ধ হওয়াতে একটু প্রাণখুলে শ্বাস নিচ্ছে। জলজ প্রাণীগুলো হয়তো উল্লাসে মেতে উঠেছে এবং মানবজাতিকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
সবকিছু উজাড় করে আমরা নষ্ট করে দিয়েছি পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান (ecosystem)। প্রকৃতি হয়তো নিজেই তার উদ্ভাবিত কলাকৌশল দিয়ে আমাদের ঘরবন্দী রেখে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে নিজস্ব শৃঙ্খলা।— জোর গলায় তা অস্বীকার করবার সাহস এবং শক্তি হারিয়ে আমরা অসহায়ের মতো যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি। ম্যালথাসের তত্ত্ব হয়তো ভুল, অথবা ওটা কোনো তত্ত্বই নয়। কিন্তু প্রাকৃতিক নিরোধকে—এ অসহায় পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে—অস্বীকার করার সাহস আছে কার!