ইউকে রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংবাদপত্র ও সংবাদিকতা : প্রেক্ষিত সিলেট

আবদুল কাদের তাপাদার: রাজধানীর বাইরে জেলা, উপজেলা কিংবা গ্রাম থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে মফস্বল পত্রিকা বলার অযৌক্তিক রীতিকে ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশ যোগ্যতা বিস্তৃত হওয়ার কারণে দেশের কোনো অঞ্চলই এখন আর প্রান্ত নয়। যদিও আঞ্চলিক সংবাদপত্র নামে প্রান্তিক সংবাদপত্রগুলোকে চিহ্নিত করার কোনো যথার্থতা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে বর্তমানে স্থানীয় পত্রিকাবলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রথম আঞ্চলিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় রংপুর থেকে ‘রংপুর বার্তাবহ’ ১৮৪৭ সালে। এরপর সিলেট থেকে বড়লেখার অধিবাসী প্যারীচরন দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’। এটাকেই সিলেট অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। গত প্রায় ২শ বছরে দেশের জেলা, উপজেলা শহর এমনকি গ্রাম থেকে অসংখ্য স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এখন সরকারি তালিকাভুক্ত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ৭৭০ টি। এই তালিকার বাইরেও আরো স্থানীয় সংবাদপত্র রয়েছে। যে কোন বিচারে এই বিপুল সংখ্যক স্থানীয় সংবাদপত্র বড় আকারের সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি। নির্দিষ্ট কৌশলের সহযোগি হিসেবে ব্যবহার করলে মানবিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এসব পত্রিকা যুগান্তকারী ফল বয়ে আনতে সক্ষম।
আগে যেমন ছিল বর্তমানেও তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক সংবেদনশীল স্বপ্নবান মানুষ যারা মানবিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। সমাজের কল্যাণ চিন্তাথেকেই তারা সংবাদপত্র প্রকাশনায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। স্থানীয় পত্রিকার সাথে এর পাঠকদের সম্পর্ক কেবল কম পয়সার নয়। বরং স্থানীয় আবেগের, ঐতিহ্য এবং অহংকারের। বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর আধেয় আহরনের উপায় এখন প্রযুক্তির কারণে বিস্তৃত। ঢাকার পত্রিকার অনুকরণে স্থানীয় পত্রিকায় জাতীয় ইস্যু থাকে বটে, কিন্তু স্থানীয় ইস্যু সমূহই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। রাজধানীর দৈনিক সমূহের রাজনীতি,নগর ও অভিজাত কেন্দ্রিকতার বিপরীতে স্থানীয় সংবাদপত্রে স্থানীয় গণমানুষের কথা থাকে বেশি। এভাবে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো দেশের সামগ্রিক তথ্য প্রতিবেশের গণমুখী নিয়ন্ত্রক। মফস্বলের সংবাদপত্র আকারে ক্ষুদ্র হলেও এর শক্তি অল্প নয়। স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্ভাবনা অনেক। তৃণমূল জনগণের কাছাকাছি থাকে বলে সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশ করা তাদের আবেগ এবং আকাংখার জায়গাটিতে নাড়া দেয় স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ।
সাম্প্রতিককালে সংবাদপত্র প্রকাশ একটি সৌখিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অন্যান্য পেশার মতো সাংবাদিকতাকে অনেক ক্ষেত্রে চাকুরী হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। সামান্য পুঁজি থাকলে একটি ব্যবসা খোলার মতো ব্যাপার হয়ে গেছে সংবাদপত্র প্রকাশ। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পূর্ব ধারণা না নিয়েই যে কেউ সম্পাদক হতে পারছেন। অনেকে ডিক্লারেশন কিনে মালিক সম্পাদক হচ্ছেন। অবশ্য পত্রিকা চালাতে মেধাবী সংবাদকর্মীদের তারা কাজে লাগাচ্ছেন। অল্পমূল্যে কিনে নিচ্ছেন তাদের মেধা শ্রম। পত্রিকা এখন ক্ষেত্রবিশেষে আত্মরক্ষা এবং সাফল্যের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করছে। নিরাপদ ঢাল হিসেবে কখনো বা রাজনৈতিক স্বার্থে, কখনও স্বীয় অপকীর্তি ঢেকে রাখতে পত্রিকার মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষনীয়, সংবাদ শিরোনাম হবার কথা এমন বহুলোক এখন মালিক সম্পাদক। পত্রিকার মালিক সম্পাদক হবার কারণে প্রশাসনিক আনুকুল্য, ব্যবসায়িক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক পরিচিতি সম্মান তাদের বাড়তি লাভ। অপেশাদারদের প্রতিযোগিতায় পেশাদার সাংবাদিকরা এখন অসহায়। এসব কারণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের ভূমিকা ও ভাবমূর্তি ম্লান হচ্ছে। সংবাদপত্র হারাচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাংবাদিক বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের হাতে ব্যবহার হবার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
সংবাদ কিংবা গণমাধ্যম নিয়ে এখন ঘরে বাইরে আলোচনা সমালোচনা চলছে। চলছে তুমুল বিতর্ক। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম কার স্বার্থ দেখছে মালিক পক্ষের, রাজনৈতিক দলের, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর না সাধারণ পাঠক সমাজের। গণমাধ্যম কি কঠিন সত্য বা সংবাদপত্রের সত্য উচ্চারণ করতে পারছে? সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকদের হাতে, সরকারের হাতে না কোনো প্রেসার গোষ্ঠীর হাতে? বাংলাদেশে গণমাধ্যম কি এখন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে? গণমাধ্যম কি সত্যি সত্যিই স্বাধীনতা ভোগ করছে/ ঢাকার খ্যাতিমান সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির নির্মম ও দেশনাড়া দেয়া হত্যাকান্ড এবং হত্যাকারীদের আড়াল করতে রাষ্ট্রেরই নিরন্তর চেষ্টা তদবির এবং নির্ভীক সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও চরম নির্যাতনের ঘটনার পর দেশে সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্র শিল্প কোথায় দাঁড়িয়ে আছে-এমন অসংখ্য প্রশ্ন আর নানা জিজ্ঞাসার মাঝে এখন বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্প ঘুরপাক খাচ্ছে।
সারাদেশ জুড়েই স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়ছে। পাঠক ও বাড়ছে নিঃসন্দেহে। গত বছর টিআইবির উদ্যোগে ঢাকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উপর একটি ওয়ার্কশপে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। সেখানে ঢাকার বাইরের দেশের সব প্রান্তের জেলা এবং উপঝেলা থেকে প্রায় আড়াই শত সাংবাদিক অংশ নেন। আলোচনার স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদপত্রের মান নিয়ে কথা উঠে আসে। অনেকেই স্থানীয় সংবাদপত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা ছাড়াই নামে মাত্র সাংবাদিক দিয়ে অনেক স্থানে সংবাদপত্র বের করা হচ্ছে। এসব সংবাদপত্র পাঠক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা সৃষ্টি করতে পারছে না। উল্টো সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের বদনাম কুড়িয়ে আনছে কোন কোন সংবাদপত্র। যারা সংবাদপত্র বের করছেন তাদেরকে অবশ্যই যোগ্যতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে একটি পাঠকপ্রিয় সংবাদপত্র উপহার দেয়ার আহবান জানানো হয়। জাতীয় পর্যায়ের এই কর্মশালায়। কর্মশালায় স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রে দেশে বিরাজমান ভয়াবহতম সব ঘটনা দুর্ঘটনা অথবা গুম হত্যা দুর্নীতি এবং পুলিশের গুলিবর্ষণে মানুষ হত্যা আবার এসব ঘটনায় পুলিশই বাদী হয়ে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়েরের প্রসঙ্গ নিয়েও তুমুল আলোচনা হয়। স্থানীয় সংবাদপত্রে এসব চোখে দেখা অনেক ঘটনাই আজকাল সত্য করে বলা যাচ্ছে না, লেখা যাচ্ছে না। একজন সাংবাদিক চোখে দেখেছেন একজন মানুষকে জোর করে আইন শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হচ্ছে। এরপর থেকে তিনি গুম। ঐ সাংবাদিক তার পত্রিকায় এই সংবাদ ঠিক এভাবে লিখতে গিয়ে তার কলম থেমে যাচ্ছে। নিজেকে নিয়ে এক অজানা আতংকের কথা ভেবে। পরিণতিতে যদি ঐ সাংবাদিকই গুম হয়ে যান প্রভাবশালী ঐ চক্রের হাতে। দেশে এখন এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এলাকার জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে বড় অংকের দুর্নীতির সব কাগজপত্র আপনার হাতে আছে। ৩ কোটি টাকার ঐ দুর্নীতি নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লিখার সাহস এখন হারিয়ে ফেলছেন সাংবাদিকরা। কারণ আতংকে উদ্বেগ আর চরম নিরাপত্তাহীনতা। সমাজে প্রতিনিয়ত বিরাজমান এক ধরণের ফ্যাসিবাদী আতংক উদ্বেগ উৎকন্ঠা আর চরম নিরাপত্তাহীনতার মাঝেই এখন কাজ করতে হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের। রিপোর্ট লিখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনার আসল সত্যকে চেপে রেখেই বুকে চাপা কষ্ট ধারণ করে দায়সারা গোছের একটি বিবরণ তুলে দিচ্ছেন সংবাদপত্রে। আর প্রকৃত ঘটনার বিবরণ নিজের ডায়রীতে লিখে রাখছেন রিপোর্টার এই আশায় যে, যদি কোনকালে সময় আসে প্রকৃত সত্য লেখার। তবে মাঝে মধ্যেই নির্ভীক এবং সাহসী কেউ কেউ চেপে দিচ্ছেন সত্য ঘটনাই। পরিণতিতে মামলা জেল নির্যাতন এমনকি হত্যা, গুম এমনি এক পরিস্থিতি যখন দেশে বিরাজমান, এই সময়েই নির্ভীক এবং সত্যসন্ধানী সাংবাদিক কাজী জামাল উদ্দিনের সম্পাদনায় বাজারে আসছে নতুন সাপ্তাহিক ‘আলোকিত বিশ্বনাথ’।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩৩৪ টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সাপ্তাহিক পাক্ষিক এবং অন্যান্য সাময়িকী মিলিয়ে নিয়মিত প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ৭৭০ টি (বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট বা পিআইবির তথ্য অনুযায়ী)
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ গত ১৫ বছরে দেশের মিডিয়া জগতে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। বাংলাদেশে বতৃমানে ১৭ টি টিভি চ্যানেল এবং ৮টি রেডিও চালু আছে। দেশের ৪৫ শতাংশ পরিবারের কাছে টেলিভিশন রয়েছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারী মানুষের সংখ্যা ১১০ মিলিয়ন এবং দেশের শতকরা ৬১ ভাগ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
এতসব অত্যাধুনিক মিডিয়ার মাঝেও স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংবাদপত্র স্থানীয়ভাবে আলাদা এক ধরণের ‘রাজ্য’ এবং সংবাদপত্রে ভিন্ন ধরণের ‘শাসন’ গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে প্রধান ধারার গণমাধ্যম এদেশের রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তনে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশিত হয় বলেই স্থানীয় পত্রিকা সমূহ জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসমূহের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। স্থানীয় সংবাদপত্র এলাকাবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণ, জনগণের সচেতন ও সক্রিয় করার কাজে অধিকার বাস্তবায়নে কতটুকু কাজ করছে তা অবশ্যই গবেষনার বিষয়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব। ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ এর নয়। - সম্পাদক

সর্বশেষ সংবাদ