ইউকে বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

রাজনীতির ময়দানে ডানপন্থীদের দৃশ্যমানতা বাড়ছে

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :দেশের রাজনীতিতে ডানপন্থী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তা ও দৃশ্যমানতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের পর এই পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেকের কাছে এটি এক ধরনের ‘উত্থান’ মনে হলেও বিশ্লেষকদের মতে, বিষয়টি নতুন নয়; বরং দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা এসব দল পুরনো রাজনৈতিক অবস্থানে ফিরে আসছে।

প্রায় ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা ছিল ইসলামপন্থী দলগুলো। সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা মিডিয়ায় তাদের তেমন কোনো উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেই ফাঁকা স্থানেই নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠে ইসলামপন্থীরা।

সাম্প্রতিক সময়ে এসব দল নানা দাবিতে বড় বড় সমাবেশ করছে। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর এক বিশাল সমাবেশ হয়, যা দলটির ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত। এতে নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “আগামী দিনে সংসদে কেবল ইসলাম থাকবে। কোরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো মতবাদ চলবে না।”

এর আগে একই স্থানে মহাসমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তারা নির্বাচন ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতির দাবি, ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’-এর বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামও নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে বিশাল সমাবেশ করে।

তবে এই রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি নানা বিতর্কিত ঘটনার সঙ্গেও ডানপন্থীদের নাম জড়িয়েছে। রোজার সময় দোকান বন্ধে চাপ, মাজার ভাঙচুর, থিয়েটার বন্ধ, বাউলদের বাদ্যযন্ত্র ভাঙা, নারীদের ফুটবল ম্যাচ বাতিল এবং পোশাক নিয়ে হেনস্তার মতো ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।

শুধু মাঠের রাজনীতি নয়, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেও ডানপন্থীদের প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিতে পাঠ্যপুস্তক সমন্বয় কমিটির দুই সদস্যকে অপসারণ করা হয়। অভিযোগ ছিল, পাঠ্যবইয়ে ধর্মবিরোধী বিষয়বস্তু রাখা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ধর্মভিত্তিক দলের প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এ প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, ইসলামপন্থীদের এমন সক্রিয়তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

তবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দাবি, এটি কোনো উত্থান নয় বরং রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “আমরা বহু বছর ধরে রাজনীতি করে আসছি। নতুন করে কারো উত্থান হয়নি। বরং দীর্ঘদিন দমন-পীড়নের শিকার হয়েছি। এখন স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি।”

এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন বামপন্থী রাজনীতিক সাইফুল হক। তিনি মনে করেন, ডানপন্থী দলগুলো এখন শুধু রাজনীতির মাঠেই নয়, বরং রাষ্ট্রের ভেতরেও—প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার স্তরগুলোতেও—অনানুষ্ঠানিক বলয় তৈরি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, “যারা এতদিন ক্ষমতার আশপাশে ছিল, তারা এখন নিজেই বড় শক্তি হয়ে উঠছে—এটা বিস্ময়কর।”

আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিষয়টি নজরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) গত ২১ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার চললেও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসও এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, গণঅভ্যুত্থানের পর ‘কট্টরপন্থীরা’ নতুন করে রাজনৈতিক সুযোগ নিচ্ছে।

তবে ইসলামপন্থী রাজনীতি বিশ্লেষক শরীফ মুহাম্মদ বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত মনে করেন। তাঁর মতে, এই রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন নয়। বরং বামপন্থীদের অনুপস্থিতি ও সেক্যুলার দলগুলোর দুর্বলতার কারণে ইসলামপন্থীরা এখন বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। “এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়,” বলেন তিনি, “বরং রাজনৈতিক ভারসাম্যের স্বাভাবিক ফল।”

তবে রাজনীতির মাঠে ডানপন্থীদের এই নতুন সক্রিয়তা স্থায়ী হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন ও নতুন সরকার কাঠামোর ওপরেই নির্ভর করবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান। তবে এটুকু নিশ্চিত—ডানপন্থীরা রাজনীতির ময়দানে ফিরেছে, এবং তাদের প্রভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ