
ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখনও গোটা জাতি স্তম্ভিত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কোমলমতি শিশুরা বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল। মা চিরুনি দিয়ে চুলে সিঁথি করে দেন; ব্যাগে গুছিয়ে দেন টিফিন বক্স। আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে কপালে চুমু এঁকে দেন। প্রহর গুনতে থাকেন, ছুটি হলেই বুকের ধন ফিরবে। কিন্তু আর ফেরা হয়নি তাদের। বরং দিন যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
সে সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বহু শিক্ষার্থী আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারও ৫০ শতাংশ কিংবা তার বেশি বা কম পুড়ে গেছে। স্কুলের বন্ধু, সহপাঠী-স্বজনদের হারিয়ে কোমলতি শিশুরা নির্বাক হয়ে গেছে। শিশুশিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবক-স্বজন যারা বিমান দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাদের দুর্বিষহ স্মৃতি তাড়া করছে। কচিকণ্ঠের হাসি স্তব্ধ হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে প্রাণচাঞ্চল্য। এখনও শিশুরা ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে ওঠে। স্কুলে যাওয়ার কথা শুনলেই ভয় পায়। এখনও আকাশে বিমানের শব্দ কিংবা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পেলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেও যেখানে থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল, সেখানে মৃত্যুকে জয় করে ঘরে ফিরেছে দুই শিক্ষার্থী। হাসপাতালের ছাড়পত্র পাওয়া শিক্ষার্থীদের একজন ১২ বছর বয়সি আয়ান খান; আরেকজন একই বয়সি রাফসি আক্তার রাফিয়া।
শনিবার বেলা ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দিনেই তাদের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। অন্যদের তুলনায় তাদের দুজনই তুলনামূলক কম দগ্ধ হয়েছিল। ফলে খুবই দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠায় তাদের দুজনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দগ্ধ হওয়া দুই শিশুর মধ্যে একজন হলো মাইলস্টোন স্কুলের রাফসি আক্তার রাফিয়া। তার বাবার নাম মো. শামিম হোসেন এবং মায়ের নাম আঁখি আক্তার। দুই সন্তানের মধ্যে রাফিয়া ছোট। তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে।
সেই ভয়াবহ দিনে স্মৃতিচারণা করে মো. শামিম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, বিমান দুর্ঘটনার সময়ে তার মা স্কুলেই ছিল। প্রতিদিনের মতোই মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল। তিনি হঠাৎ দেখেন বিমান স্কুল ভবনের ওপরে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। যেখানে বিমান পড়েছে সেখানেই মেয়ের ক্লাস ছিল। তার মা পাগল হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আমাকে ফোন দিয়ে জানালে আমিও দ্রুত স্কুলে আসি। অনেক খোঁজাখুঁজি শুরু করি। জানালা দিয়ে মেয়েকে ডাকি। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন ছিল। এর মধ্যে বাচ্চাদের পোড়া দেহ পড়ে আছে। ব্যাগ, টিফিন, বাচ্চা ও অভিভাবকদের চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি আর গগনবিদারী আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এই দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেয়ামতের ময়দান। আমাদের মতো সব অভিভাবকের অবস্থাই করুণ। বাচ্চাদের না পেয়ে প্রতিটা মা-বাবা-স্বজনদের যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, এটা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
তিনি বলেন, অনেক খোঁজ করার পর রুমের মধ্যে মেয়ের ব্যাগ পাই। তখন কলিজাটা শুকিয়ে গেছিল। মনে হচ্ছে অন্যসব বাচ্চার মতো আমার মেয়েটাও আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এক পর্যায়ে আমার বন্ধুর একটা ফোন পাই। সে আমার মেয়ের নাম বলতে পারছিল না। পরে ছবি পাঠায়। তখন আমার শরীর কাঁপছিল। মেয়ের ছবি দেখে শরীরের কাঁপুনি থামে। সেই বন্ধু জানায় উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেয়ে ভর্তি আছে। হাতের কিছু অংশ আগুনে পুড়ে গেছে। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। তখন দৌড়ে আমরা হাসপাতালে যাই। আমি শুনেছি এক ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মেয়েকে উদ্ধার করে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরে আসি। চিকিৎসকরা দুদিন বাসায় থাকতে বলেন। দুদিন পর আবার চিকিৎসকরা ব্যান্ডেজ যখন খোলেন তখন মেয়ের হাত দেখে অবাক হয়ে যাই। পোড়া হাতে ফোসকা পড়ে লাল হয়ে ভেতরের চামড়া দেখা যাচ্ছে। ওখানে আর দেরি না করে বার্ন ইউনিটে চলে আসি। সেখানে তিন দিনের চিকিৎসায় মোটামুটি ভালো হওয়ায় আজ (শনিবার) রিলিজ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
শামিম হোসেন বলেন, চোখের সামনে কত বাচ্চাকে যন্ত্রণায় ছফছট করতে দেখেছি। হাসপাতালে অনেকেই মারা গেছে। এখনও অনেকেই ভর্তি রয়েছে। প্রত্যেকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। আর যেসব বাচ্চা মারা গেছে তাদের মা-বাবার মনের অবস্থা কত খারাপ হতে পারে। তিনি জানান, দগ্ধ হওয়ার পর থেকেই তার মেয়ে ঘুমাতে পারে না। ঘুমাতে গেলেই আঁতকে ওঠে এবং চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরে। এত সহপাঠীর মৃত্যু, আগুনে পোড়া শরীর দেখে যে কেউ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক।
হাপাতাল থেকে মৃত্যুকে জয় করে বাসায় ফেরা আরেক শিক্ষার্থী চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়ান খান। সে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাদের বাড়ি সাভারের আশুলিয়ায়। শিশুটির বাবার নাম মোস্তফা কামাল বাপ্পী। তিনি ব্যবসা করেন। মায়ের নাম হামিদা আক্তার রিয়া। তাদের বাসা ঢাকার উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে। বিমান দুর্ঘটনার বীভৎস্য দৃশ্য বর্ণনা করে শিশুটির ফুপু শান্তা ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, আমিই আয়ানকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলাম। খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে বিমানটি স্কুলের ভবনের ওপর আছড়ে পড়ল। প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাচ্চা-অভিভাবকদের কান্নার রোল এখনও মনে হলে শরীর হিম হয়ে আসে।
আমিও আমার ভাতিজার চিন্তুায় এক প্রকার পাগল হয়ে গেছিলাম। কী ভয়াবহ আগুন কাছে যাওযার কোনো উপায় ছিল না। এক পর্যায়ে আগুনের তাপ কিছুটা কমলে যখন বাচ্চাগুলো আনা হচ্ছিল কারও শরীর পুরোটা পুড়ে গিয়েছিল, মুখ-পেট, পিঠ, হাত-পা থেকে চামড়া খসে পড়ছিল। মাথার চুল পুড়েছিল। অনেককে চেনার কোনো উপায়ই ছিল না। এক পর্যায়ে আয়ানকে স্কুলের গেটের সামনে খুঁজে পাই। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশ মেডিকেলে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কোনো জায়গা নেই। রোগী আর রোগী। সেখানে থেকে উত্তরা ক্রিসেন্টসহ তিন হাসপাতাল ঘুরেও কোনো জায়গা পাচ্ছিলাম না। পরে বার্ন ইউনিটে নিয়ে এসে ভর্তি করাই। সেখান থেকে শনিবার বিকালে রিলিজ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, আগুনে আয়ানের শরীর তুলনামূলকভাবে কম পুড়েছে। তবে তার দুই কানে ও হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। হাতগুলো সেদ্ধর মতো লাল লাল ছোপ হয়ে গেছিল। এখন সে দিনে কোনো ধরনের ভয় না পেলেও রাতে ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠে।