
ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং গাজায় চলমান গণহত্যামূলক অভিযান আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ চিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। এই নিরবচ্ছিন্ন নিপীড়ন ও আগ্রাসনে শুধু সামরিক কিংবা রাজনৈতিক শক্তিই নয়, বড় বড় আন্তর্জাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছে—এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনটি ২০২৫ সালের ৩ জুলাই জেনেভায় একটি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। সেখানে সরাসরি ৪৮টি বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলের দখলদার ও গণহত্যাকারী নীতিকে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত সহায়তা দিয়ে চলেছে। এদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান), অ্যামাজন, পালানটিয়ার, আইবিএম, লকহিড মার্টিন এবং আরও অনেক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযান কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতিফলন নয়—এটি একটি ‘লাভজনক’ যুদ্ধেও পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে একাধিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী। এতে ‘গণহত্যার অর্থনীতি’ নামক একটি ধারণা ব্যবহার করে বলা হয়েছে— ইসরায়েলের দখল ও আগ্রাসন এখন কেবল একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল নয়, বরং এটি একটি বহুজাতিক মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে যেখানে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লকহিড মার্টিনের নেতৃত্বে অন্তত ৮টি দেশের ১৬০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলকে সহযোগিতা করছে। এর বাইরে রয়েছে, ইতালির লিওনার্দো, জাপানের FANUC করপোরেশন, সুইডেনের ভলভো, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্ডাই ইত্যাদি, যারা সরবরাহ করছে ভারী যন্ত্রপাতি এবং রোবোটিক প্রযুক্তি।
প্রযুক্তি খাতে মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজন—এই তিন জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। একইভাবে আইবিএম ইসরায়েলি সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত এবং তাদের জনসংখ্যা ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার পরিচালনা করছে। এসব তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি ও বৈষম্যমূলক নীতিমালা বাস্তবায়নে।
প্রতিবেদনে পালানটিয়ার টেকনোলজিসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য এই প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত সহায়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা এআই নির্ভর “স্বয়ংক্রিয় পূর্বাভাসমূলক পুলিশি প্রযুক্তি” সরবরাহ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘লেভেন্ডার’, ‘গোসপেল’, এবং ‘হোয়্যার ইজ ড্যাডি’ নামক টার্গেট শনাক্তকারী এআই সিস্টেম।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়েছে, যারা বেসামরিক খাতে কাজ করলেও তাদের পণ্য দ্বৈত ব্যবহারে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন—ক্যাটারপিলার, রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ, এবং ভলভো যাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে পশ্চিম তীরে বাড়ি-ঘর ধ্বংস ও অবৈধ বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে।
ভাড়া প্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম ‘বুকিং ডটকম’ এবং ‘এয়ারবিএনবি’ ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে অবৈধ বসতিতে সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করে—যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অপরাধ। রিপোর্টে ‘হিউম্যানিটারিয়ান ওয়াশিং’ শব্দটি ব্যবহার করে বলা হয়েছে—এয়ারবিএনবি প্রথমে অবৈধ বসতি সরিয়ে ফেললেও পরবর্তীতে তা আবার যুক্ত করে এবং লাভের একটি অংশ তথাকথিত মানবিক খাতে দান করে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ঢেকে রাখার এক উপায় মাত্র।
প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ, খাদ্য ও কৃষি খাতেও ইসরায়েলকে সহায়তাকারী কোম্পানিগুলোর নাম এসেছে। গ্লেনকোর ও ড্রামন্ড কোম্পানি ইসরায়েলকে কয়লা সরবরাহ করছে, যার বেশিরভাগ আসে কলম্বিয়া থেকে। চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড এবং মেক্সিকোর অরবিয়া অ্যাডভান্স কর্পোরেশন ফিলিস্তিনের দখল করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ কল-কারখানায় বিনিয়োগ করছে এবং লাভবান হচ্ছে।
এই পুরো সহায়তার পেছনে যেসব বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—ব্ল্যাকরক এবং ভ্যানগার্ডকে। এরা বহু অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানির বড় শেয়ারহোল্ডার। ব্ল্যাকরক মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, আইবিএম, লকহিড মার্টিন, ক্যাটারপিলার ইত্যাদি কোম্পানিতে উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ করেছে। একইভাবে ভ্যানগার্ডও এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শেভরন ও এলবিট সিস্টেমসের মালিকানায় অংশীদার।
এই কর্পোরেট সহায়তাগুলো কেবল নৈতিক অপরাধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ফ্রানচেসকা আলবানিজ তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘রাষ্ট্রগুলোর প্রাথমিক দায়িত্ব হল নিশ্চিত করা যে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত না হয়। এমনকি যেসব রাষ্ট্র এটি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, সেখানেও আন্তর্জাতিক আদালতের অধীনে ব্যক্তিগত নির্বাহীদের জবাবদিহির আওতায় আনা যেতে পারে।’
২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এক উপদেষ্টা মতামত জারি করে জানায়—ইসরায়েলের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দখল ‘যত দ্রুত সম্ভব’ শেষ করতে হবে। এই রায়ের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দাবি করে—ইসরায়েল ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে অধিকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে।
ফ্রানচেসকা আলবানিজ বলেন, ‘এই রায় কার্যত দখলদারিত্বকে আগ্রাসনের কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সুতরাং, যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই দখলকে সহায়তা করে, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’
তিনি আহ্বান জানান, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ইসরায়েলের দখলদার প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করে।