ইউকে সোমবার, ২ জুন ২০২৫
হেডলাইন

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ কোন দিকে যাচ্ছে?

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও মতবিরোধ। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে––এমন বক্তব্যে সরকারকে কড়া বার্তা দিয়েছে বিএনপি।

দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার এক সমাবেশে নির্বাচন নিয়ে এমন অবস্থান তুলে ধরে অভিযোগ করেন- “সরকার নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে”।

মূলত, বিএনপির ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি পুরানো। তবে এতোদিন সরকারকে সরাসরি চাপের পথে যায়নি দলটি। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পাওয়ার পর দলটি কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বুধবারের সমাবেশ থেকে নির্বাচনের দাবিতে কোনো কর্মসূচিও ঘোষণা করতে পারে বিএনপি। তবে সেটা না হলেও বিএনপি তার কঠোর অবস্থান তুলে ধরে।

তবে বিএনপি ডিসেম্বর নিয়ে নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইলেও সব দলই যে একই পথে হাঁটছে তা নয়।

নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি কিংবা ইসলামী দলগুলোর আবার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আছে। ফলে সরকার বিএনপির দাবি মানলে সেটা অন্য দলগুলোর মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–– নির্বাচন যখনই হোক, সেটার রোডম্যাপ এখন ঘোষণা করলে সমস্যা কোথায়? রোডম্যাপের ঘোষণা চাওয়া বা না চাওয়ার পেছনে দলগুলোর হিসেব-নিকেশ কী আছে?
রোডম্যাপ নেই, বিএনপি এখন কী করবে?

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি নেতারা যখন সাক্ষাত করেন তখনই ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবির বিপরীতে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস আসেনি। বরং তিনি ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন’ পুরনো এই সময়সীমাই নতুন করে তুলে ধরেছেন। বিএনপি নেতাদের সামনে।

এছাড়া বুধবারও জাপান সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস “যে কোনো পরিস্থিতিতে এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার” পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে তার প্রেস উইং জানিয়েছে।

ফলে এটা স্পষ্ট ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
কিন্তু তাহলে বিএনপি এখন কী করবে?

বিশেষ করে তারেক রহমানের ‘কড়া বার্তার’ পরও যখন সরকার থেকে কোনো রোডম্যাপের আশ্বাস নেই তখন বিএনপি আসলে কী করতে পারে?

এর উত্তরে এটা স্পষ্ট যে নির্বাচনের দাবিতে দলটি আপাতত কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না।

কিন্তু রাজনীতিতে আলোচনা হচ্ছে, বিএনপি সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরির দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু বিএনপি কীভাবে চাপ তৈরি করতে পারে?

দলটি অবশ্য ইতোমধ্যেই এর দুটো নমুনা দেখিয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ইস্যুতে টানা কয়েকদিনের আন্দোলন করে। এই আন্দোলন সরকারকে দৃশ্যত অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে পদত্যাগের জোরালো দাবি তুলে ধরে। যার ফলে সরকার তো বটেই, একইসঙ্গে ছাত্রদের দল এনসিপির জন্যও একধরনের ‘অস্বস্তিকর’ অবস্থা তৈরি হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৃষ্টি অবিশ্বাস, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে।

অর্থাৎ বিএনপি চাইলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে সেটা স্পষ্ট।

সামনে সেই চাপ আরও বাড়বে। কারণ বিএনপি ঘোষণা দিয়েই বলছে, দাবি মানা না হলে তারা আর সরকারকে সহযোগিতা করবে না।

“ইলেকশনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। এটাকে যদি প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব না দেন তাহলে সরকারকে আমরা যে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা দিয়ে যাওয়াটা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।”

বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার নয়। ফলে নানারকম অস্থিরতা এবং দাবি-দাওয়ার আন্দোলন সামাল দিতে অতীতে সরকারকে বেগ পেতে হয়েছে।

সম্প্রতি আবারও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব হয়েছে নানাপক্ষ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলছেন, এই পুরো পরিস্থিতি সরকারকে ‘বোঝানোর চেষ্টা করেছে’ তার দল। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন,

“আমরা মনে করি, বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি এবং ফ্যাসিবাদের দোসররা বিভিন্ন রকম ফাঁক-ফোকর দিয়ে বিভিন্ন অস্থিরতার প্রয়াস নেবে এবং বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া নিয়ে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা করা হবে। সেটা আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। প্রধান উপদেষ্টা যদি না বোঝেন তাহলে বিএনপি তার দাবি-দাওয়া নিয়ে জনগণের কাছে যাবে।”

রোডম্যাপ চাইলেও দিন-ক্ষণ নিয়ে সরকারকে চাপ দেবে না জামায়াত নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ডিসেম্বরের বাইরে যেতে চায় না। কিন্তু জামায়াত ও এনসিপি আবার নির্বাচনের দিনক্ষণ বেঁধে দিতে রাজি নয়।

তবে দিনক্ষণ বেঁধে না দিলেও জামায়াত চায় সরকার একটা রোডম্যাপ দিয়ে দিক। তবে সেটা শুধু নির্বাচন নয়, একইসঙ্গে সংস্কার বিষয়েও সরকার কবে, কী করতে চায় রোডম্যাপে সেটাও থাকতে হবে।

বিএনপি যেমন নির্দিষ্ট করে ডিসেম্বরের কথা বলছে, জামায়াত সেখানে কেন সুনির্দিষ্ট দিনের কথা বলছে না?

“আমরা তো বলেছি রমজানের আগে নির্বাচনের কথা। যদি সেটা না হয় তাহলে এপ্রিলের মধ্যে যেন হয় সেটাও বলেছি। কিন্তু আমরা নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দিতে চাই না। কারণ আমরা একেকটি দল যদি একেকটি মাস এবং দিনের জন্য জোরাজুরি করি তাহলে তো সেখানে সরকারের যারা সিদ্ধান্ত নেবে তাদের জন্য এক ধরনের কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হবে।”

বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

তবে বিএনপির মতো জামায়াতও এখন বলছে, সরকার যখনই নির্বাচন দিক, সেটার রোডম্যাপ এখনই দিয়ে দেয়া উচিত।

জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহম্মদ তাহের বলছিলেন, রোডম্যাপ সামনে আসলে সেটা নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাকে দূর করবে। তিনি বলেন,

“আমরা শুধু নির্বাচন নয়, সংস্কারেরও রোডম্যাপ চেয়েছি। রোডম্যাপ দিলে এই যে অনিশ্চয়তা, একে অন্যকে বিশ্বাস না করার প্রবণতা সেটা দূর হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, রোডম্যাপ দিলে এটা যদি কোনো দলের দাবি করা কাছাকাছি সময়ে হয়, তাতে কোনো অসুবিধা নেই।”

“আবার যদি এটা কোনো দলের প্রত্যাশার চেয়ে দেড়-দুই মাস পরে হয়, তাতেও মানুষ বলবে যে ইলেকশন তো হচ্ছে। একমাস/দুই মাসের জন্য কেন অস্থিরতা। সুতরাং কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইলেও সেখানে জনসমর্থন পাবে না। কিন্তু রোডম্যাপ না দিলে মানুষের মধ্যে যে একটা অনিশ্চয়তা আছে, (নির্বাচন) হবে কি হবে না, নানারকম ষড়যন্ত্রের কথাও বলা হয় সেগুলো থেকে যাবে।”
এনসিপি কী বলছে?

বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইলেও সরকার এখনই তার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। বরং ঐক্য ও সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল এনসিপিও সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার -এই তিনটি বিষয়ে রোডম্যাপ একসঙ্গে প্রকাশ করা উচিত বলে জানিয়েছে।

তবে বিএনপি যেখানে এখনই রোডম্যাপ চায়, এনসিপি সেখানে এই মুহূর্তেই রোডম্যাপ দরকার তেমনটা মনে করছে না।

বরং এনসিপি জোর দিচ্ছে, দলগুলোর মধ্যে আগে ঐক্য প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে একমত হওয়ার ওপর।

জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টি -এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েই যখন ঐকমত্য হয়নি তখন নির্বাচনের দিনক্ষণ কীভাবে ঠিক হবে?

“দেখেন, বিএনপি নির্দিষ্টভাবে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাচ্ছে। এখানে ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদ কিংবা এনসিপি -আমরা চাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক। তারপরে কোনো দল চায় সরাসরি ভোটে নির্বাচন, কোনো দল চায় সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন,” বলেন তিনি।

“ফলে এই যে দাবিগুলো এগুলো নিয়ে তো এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো একজায়গায় আসেনি। যদি সংখ্যানুপাতিক ইস্যুতেই বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলগুলোর বিরোধিতা শুরু হয়, তখন সরকারের পক্ষে এটা মিনিমাইজ করা অনেক টাফ হবে। ফলে হুট করে যে সরকার এখন নির্বাচনের একটা দিন ঘোষণা করবে, এটা তো সরকারের জন্য কঠিন। তাছাড়া যখনই সংস্কার এবং বিচার থেকে শুধু নির্বাচনের দিকেই ফোকাস করাটা শুরু হবে, তখন দেখা যাবে যে এই সংস্কারের চিন্তা-ভাবনা এক্সিকিউট করাটা সরকারের জন্য দুরূহ হবে,” যুক্ত করেন তিনি।
দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের শঙ্কা?

বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়, জামায়াত চায় অন্তত আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হোক, এনসিপি কিংবা অন্যান্য ইসলামী দলগুলো আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে সরকারের যে বক্তব্য সেটাকে সমর্থন করছে।

ফলে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি আছে এটা স্পষ্ট।

কিন্তু এই বিভক্তির মধ্যে সরকার যদি বিএনপির দাবি মেনে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা দেয় তাহলে সেটা অন্য দলগুলো, বিশেষত জামায়াত কীভাবে নেবে তা নিয়েও আলোচনা আছে।

এটা থেকে বিভিন্ন দলের মধ্যে নতুন করে বিভক্তি এবং অনৈক্য তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কার মধ্যে বিএনপি অবশ্য বলছে–– অন্য দলগুলো কী চায় সেটার বদলে জাতির জন্য কোনটা বেশি দরকার, বিএনপি সেই বিবেচনায় কাজ করছে।

“অন্য দলগুলো তাদের বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবে। সেটা আমাদের বিষয় নয়। অনেকের জন্য নির্বাচন যতো বিলম্বিত হবে, হয়তো তারা মনে করে যে রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য ফায়দা হবে। নির্বাচন যদি একদমই না হয় কারও কারও জন্য হয়তো সেটাও মঙ্গলজনক হতে পারে। কিন্তু এটা জাতির জন্য হবে দুঃখজনক এবং একটা অনিশ্চিত অবস্থা।”

বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

তবে জামায়াত অবশ্য বলছে, নির্বাচন ডিসেম্বরে হোক বা এরপরে হোক, সেটা নিয়ে জামায়াতের আপত্তি নেই।

“বিএনপি যেটা চায় এবং জামায়াত যেটা চায় -এর ভেতরে আমি খুব বেশি কোনো পার্থক্য দেখি না। জামায়াতের যেটা চাওয়া সেখান থেকেই নির্বাচন ১৫ দিন এগিয়ে আসতে পারে। বিএনপি যেটা চায়, সেখান থেকে ১৫ দিন পেছাতে পারে। এখানে মূল ক্রাইসিস যেটা সেটা হচ্ছে আস্থার সংকট। বিএনপি বা কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করছেন এই সরকার আদৌ কোনো নির্বাচন দেবে কিনা। রোডম্যাপ হয়ে গেলে এই আস্থার সংকট থাকবে না। দলগুলো নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে,”

বিবিসি বাংলাকে বলেন জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ