
ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষার জন্য আইনগত কাঠামো গড়ে তোলা হলেও বাস্তবতায় তা কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে নানা সময় নানা প্রশ্ন উঠছে। শিশু আইন-২০১৩, নারী ও শিশুর প্রতি নিপীড়ন প্রতিরোধ আইন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইনসহ বেশ কিছু আইন থাকলেও এগুলোর বাস্তবায়নে ব্যপাক ঘাটতি দেখা যায়।
বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি গত কয়েক দশকে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। সরকার ২০১৩ সালে ‘শিশু আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করে। এই আইনে শিশুদের নিরাপত্তা, অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই আইন বাস্তবে কতটুকু কার্যকর? দেশের নানা প্রান্তে শিশু নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাগুলো আমাদের চিন্তিত করে তোলে ।
সামাজিক বাস্তবতা বলছে, দেশে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে শারীরিক নিপীড়ন, যৌন নিপীড়ন, বাল্যবিয়ে, শিশু শ্রম কিংবা পারিবারিক সহিংসতা এগুলো আশেপাশের প্রতিনিয়তকার ঘটনা। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই শিশু নির্যাতনের মর্মন্তুদ ঘটনার বিবরণ চোখে পড়ে। আইনের বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল, ফলে অনেক অপরাধীর শাস্তি হয় না বা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এছাড়া অনেক শিশু ও তার পরিবারই জানেন না কীভাবে আইনগত সহায়তা নিতে হয়, বা জানলেও ভয়ের কারণে এগিয়ে আসেন না।
বাংলাদেশে শিশু আইন নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকলেও বেশ কিছু কারণে এটির প্রায়োগিক ব্যবহার খুব কম পরিলক্ষিত হয়ে থাকে —
প্রথমত, আইনটি কাঠামোগত দিক থেকে এটি একটি অগ্রসর ও আধুনিক আইন। এখানে শিশুদের বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক পুনর্বাসন, এবং শিশুদের জন্য আলাদা কোর্টের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই আইন বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মানবসম্পদ নেই। অনেক জায়গায় শিশু আদালত এখনও চালু হয়নি বা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের অনেক সদস্য এই আইন সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত নন। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়, আর অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পায় না।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জগুলোকেও উপেক্ষা করা যাবে না। এখনো কমবেশি অনেক গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। অনেকে এই প্রথাকে ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন করেন। শিশু শ্রম বা গৃহকর্মী হিসেবে শিশুদের ব্যবহারকে অনেক পরিবার দরিদ্রতার অজুহাতে বৈধ করে তোলে। এসব সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তনে আইন একা কার্যকর হতে পারে না। এর জন্যে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা ও শিক্ষা।
তৃতীয়ত, শিশু সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ের নানা ধরণের অভাব রয়েছে। অনেক এনজিও শিশুদের নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত নয়। একদিকে সরকার আইন প্রণয়ন করছে, অন্যদিকে সেটির বাস্তবায়নে তদারকির ঘাটতি রয়েছে। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে পরিবার, স্কুল, কমিউনিটি ও রাষ্ট্র সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে এক হাজার ১৫১ জন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১০টি ঘটনায় মামলা হয়েছে কেবল।
অন্যদিকে, দেশে শিশুশ্রমিক বৃদ্ধির হারও বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ২০১৩ সালের তুলনায় গত দশ বছরে শিশুশ্রমের সংখ্যা ৪.৫৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৬.৯৮ লাখ, যা সর্বশেষ জরিপ অর্থাৎ ২০২২ সালে বেড়ে পৌঁছেছে ১৭.৭৬ লাখে ।
শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সাথে একত্রে কাজ করে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও বাংলাদেশে ‘শিশু আইন, ২০১৩’ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ কিন্তু এটি এখনো পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে, শিশু আদালতকে কার্যকর করতে হবে, এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করা সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে আরও দরকার গণসচেতনতা এবং শিশুদের অধিকারগুলো সমাজে স্বীকৃতি দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।