ইউকে বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫
হেডলাইন

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরাতে সরকারের আপত্তি কোথায়

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :বাংলাদেশে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যখন উদ্বেগ বেড়েছে, এমন প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। রাজনীতিকদের অনেকে মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যই এক ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান হচ্ছে।

যদিও ছাত্র-শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে অংশ নেওয়াদেরও অনেকে তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।

বার বার দাবির ওঠার পরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তনের ব্যাপারে সরকারের আপত্তি কেন, এ প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

দেশে সেনা-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ অভিযানের এক মাস পার হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সেভাবে হয়নি; বরং সাধারণ নাগরিকের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

ফলে সরকারও পরিস্থিতিটাকে একেবারে নাকচ করে দিতে পারছে না। তাদের দিক থেকে বার বার কঠোর হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারের এমন সব কথায়ও মানুষ আস্থায় নিতে পারছে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

তারা বলছেন, মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা ঠেকানোসহ বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সেকারণে সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছে।

রাজনীতিকদেরও অনেকে মনে করেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না।

অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যদি ঢেলে সাজাতে চায়, তা বিবেচনা করা যেতে পারে।”

তবে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানোর পক্ষে নয়।

দলগুলোর মতপার্থক্য কোথায়

এখনও পর্যন্ত সবক’টি সক্রিয় রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ব্যাপারে কোনো দলেরই দ্বিমত নেই।

তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানোর বিভিন্ন পক্ষের দাবির ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে।

কোনো কোনো দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে। আবার কোনো কোনো দল বলছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, পরিস্থিতি সামলাতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ দৃশ্যমান করতে হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনতে চাইলে, সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে।

দলটির মিত্রদের কেউ কেউ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির পক্ষে সরাসরি অবস্থান তুলে ধরছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ্ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবির যৌক্তিকতা আছে।”

কারণ তিনি মনে করেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না।

এ ধরনের অবস্থানের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ব্যর্থতার কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

এখন রোজার মধ্যে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার সফল হলেও তা নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে। এই ইস্যুতেই অন্য সব কিছু ছাপিয়ে সরকারের সমালোচনা বাড়ছে।

দলগুলো মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের প্রতি আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেখানে কঠোর নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও মানুষ তাতে আস্থা পাচ্ছে না। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন করা হলে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থি কয়েকটি দল।

জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরালে সমাধান হবে না। সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হইতেছে; আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

ইসলামপন্থী দলগুলোও একইরকম বক্তব্য দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। সেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরিয়ে কোনো সমাধান আসবে না।

জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও পরিস্থিতির পেছনের ‘ষড়যন্ত্র’ তত্তের ব্যাপারে একমত বলে মনে হয়েছে।

সরকারের দিক থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং এমনকি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও তাদের গত কয়েকদিনের বক্তব্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল যখন নিজেরাই বলছে যে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দায় এড়াতে পারেন না, সেখানে দায় এড়ানো চেষ্টা হলে সেটা ভিন্ন বার্তা দিতে পারে। অপরাধীরা আরও সুযোগ নিতে পারে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগে আপত্তি কোথায়

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেহেতু সংস্কার-নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয়ে বিতর্ক বা আলোচনাকে পেছনে ফেলে এখন বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানো হলে বা তিনি পদত্যাগ করলে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। সরকারের আপত্তির ক্ষেত্রে এটিই অন্যতম বড় কারণ। সরকারের ভেতরে একাধিক সূত্রে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুজন উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের দুজনই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে দায়িত্বে থাকা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল। তার আগে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দিকেই সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে তাকে সরানোর প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।

তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, তার সেই বক্তব্য গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার বিপক্ষে যায়।

এই অভিযোগে সরকারে থাকে ছাত্র প্রতিনিধি ও আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের চাপের কারণে তখন সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সরকারেরই একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে আগে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে সরাতে হয়েছে। এখন ব্যর্থতার অভিযোগে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সরানো হলে এর কোনো নেতিবাচক দিক থাকে কি না, এ বিষয়টিও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বিবেচনায় থাকতে পারে।

অবশ্য সরকারের কোনো সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার। তবে উপদেষ্টাকে না সরিয়ে সরকার আরও কঠোর হওয়ার চিন্তা করছে।

সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হওয়ার বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে মাগুরায় এক শিশু নিপীড়নের ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

এমন পটভূমিতে কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আরও দুজন উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করার বিষয়েও সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দেওয়ার পর সম্প্রতি মাগুরায় ওই শিশুকে নিপীড়নের ঘটনাসহ বিভিন্ন অপরাধের ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকায় নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের মিছিলে পুলিশ বাধা দিয়েছে।

তবে পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা মনে করেন, সরকারের পদক্ষেপ নিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফলে তা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এ নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিভিন্ন পদক্ষেপে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হবে তা বলা মুশকিল।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি কেন সামনে এলো

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ যেভাবে ঘটছে, এই নাজুক পরিস্থিতি কেউ অস্বীকার করতে পারছে না।

সেনা-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর অপারেশন ডেভিল হান্টের এক মাস পার হলেও অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমছে না। কিছুদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ-ও বলেছিলেন যে, ‘টের পাওয়ার’ মতো পদক্ষেপ তারা নিচ্ছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসবের পরও সম্প্রতি ঢাকার বাইরে একটি গ্রামের হাটে ঘোষণা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাদের খাজনা দেওয়ার জন্য দোকানদারদের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও দলটি এ ধরনের ঘটনার কথা অস্বীকার করেছে।

এছাড়া সড়কের ওপর প্রকাশ্যে দম্পতিকে কোপাচ্ছে এলাকার মাস্তানেরা, চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, নারীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ সব ঘটনা মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম থেকেই দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব হামলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, তা সামলানো যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সায় থাকার অভিযোগও রয়েছে। ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুনের ঘটনায়ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি।

সব মিলিয়ে সরকারের দুর্বলতা ও অদক্ষতার বিষয় আলোচনায় এসেছে। আর এ কারণে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, কোনো অপরাধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। অপরাধীরাও সেই সুযোগ নিয়েছে। ফলে সামাজিক অপরাধ বেড়ে গেছে।

এই পরিস্থিতির দায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এড়াতে পারেন না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজেও পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারির শেষে তিনি মধ্যরাতে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

সেই সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেছেন, তিনি কাজ করছেন। কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পদত্যাগের বিষয় আসবে কেন।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ