ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সহিংসতার রেশ প্রতিবেশী ভারতের সামাজিক মাধ্যমেও আলোড়ন তুলেছে। এই আন্দোলনের ছবি বা ভিডিও বলে দাবি করে বহু পোস্ট ভারতের ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ বা এক্সেও (সাবেক টুইটার) দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যার অনেকগুলোই রীতিমতো সাম্প্রদায়িক লেবাস লাগানো হয়েছে।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্যগুলো জানায়। বিবিসির নিজস্ব অনুসন্ধানে বা ভারতেরও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং সাইটের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব ভিডিওর বেশির ভাগই অনেক পুরনো– যেগুলোকে বিকৃত ন্যারেটিভে পেশ করা হচ্ছে। এর অনেকগুলোতেই সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে, কিংবা একটা ঘটনার ছবি বা ভিডিও সম্পূর্ণ অন্য ঘটনার বলে চালানো হচ্ছে।
সোজা কথায়, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি করে ভারতে যেসব পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে– তার বেশির ভাগই এখন ‘ফেক নিউজ’ বলে দেখা যাচ্ছে বা প্রমাণিত হচ্ছে।
এসব পোস্টের অনেকগুলোতেই দাবি করা হয়েছে, ওই আন্দোলনের চরিত্র ছিল ‘হিন্দু-বিরোধী’ বা ‘ভারত-বিরোধী’, যদিও তার সমর্থনে কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তারা দিতে পারেননি।
গত দু’সপ্তাহে ভারতে এরকম যে পোস্টগুলো সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত ছিল এরকম:
>“ঢাকার একটি ‘হিন্দু হোস্টেলে’ জামায়াতের আক্রমণের শিকার হিন্দু ছাত্ররা ছয় তলার ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলছে। কতজন ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল দেখুন!” অথচ এই ভিডিওটি চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলার দৃশ্য ছিল বলে জানা যাচ্ছে।
>“ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি”– এই স্লোগান দিয়ে ঢাকার রাজপথে ভারত-বিরোধী মিছিল যাচ্ছে। তবে পরে দেখা গেছে, এই মিছিল আদৌ কোটা আন্দোলনের সময়কার নয়, বরং গত জুন মাসে ভারতকে ‘রেল ট্রানজিট’ দেয়ার বিরোধিতা করে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচির অংশ।
>ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দু’জন বোরখা পরিহিত তরুণী স্কুটারে করে এসে পানির বোতল বিতরণ করছেন, এই ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে– এর মাধ্যমে যে নারীরা বোরখা পরে নেই (অর্থাৎ হিন্দু নারীরা) তাদের ধর্ষণে উৎসাহিত করা হচ্ছে!
>একটি ‘মিম’ ভারতে খুব ছড়িয়ে পড়েছে, যার বক্তব্য হল “বাপ কলকাতার আর এন টেগোর হাসপাতালে ভর্তি, ছেলে ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে– ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।” অর্থাৎ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, পরিবার-পরিজনের চিকিৎসার জন্য যাদের প্রায়ই ভারতে আসতে হয়, তারা কীভাবে ঢাকায় ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতে পারেন?
বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনকে দমন করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে বলেও একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়েছিল। যথারীতি সেই দাবিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল।
গত ২১ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানের জরুরি বৈঠকে ভারতীয় হাই কমিশনারও উপস্থিত ছিলেন, এমনও দাবি করা হয়েছিল কোনও কোনও পোস্টে। এটাও পুরোপুরি ‘ফেক নিউজ’ ছিল, বলাই বাহুল্য। এবং এই ধরনের পোস্ট ছিল আরও অজস্র, এই প্রতিবেদনে যার কয়েকটি নিয়ে বিশদে আলোচনা করা হল।
গত ২১শে জুলাই (রবিবার) – বাংলাদেশে সহিংসতা তখনও থামেনি – ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রভাবশালী নেতা জিতেন্দ্র প্রসাদ সিং এক্স হ্যান্ডলে ঢাকার রাজপথে একটি মিছিলের ভিডিও পোস্ট করেন।
সঙ্গে তিনি লেখেন : “বাংলাদেশে সংরক্ষণের (কোটা) বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চলছে সেটা এখন ভারত-বিরোধিতা আর হিন্দু-বিরোধিতায় বদলে গেছে।”
“এই বিক্ষোভকারীরা মাইকে ঘোষণা করছে – ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি!”
ভিডিওটি নিয়ে তিনি লিখেছেন “এটাও আমরা জানতে পারছি যে বাংলাদেশে যে হাতেগানা কিছু হিন্দু টিঁকে আছেন, এই আন্দোলনের অজুহাতে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ও তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। পুরো বাংলাদেশে আসলে একটা ভারত-বিরোধী পরিবেশ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে।”
মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া একজন নেতাকে ওই ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, “ভারত যাদের মামার বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি … দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা … ভারতের আগ্রাসন, রুখে দাও জনগণ … কিংবা ভারতীয় পণ্য – বর্জন বর্জন” প্রভৃতি স্লোগান।
এই ভিডিও ও পোস্ট ভারতে অসংখ্য লোক শেয়ার করেন, অনেকেই আন্দোলনকারীদের গালিগালাজ করে কমেন্ট করতে থাকেন।
এর সপ্তাহখানেক পরে ভারতের ‘দ্য কুইন্ট’ পোর্টালের ফ্যাক্টচেকিং টিম ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে জানায়, এটি ঢাকার একটি সাম্প্রতিক ভিডিও হলেও আদৌ কোটা আন্দোলনের সময়কার নয়।
তারা আরও জানায়, “ভিডিওটি ঢাকার হলেও এর পটভূমি সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিক্ষোভকারীরা গণ অধিকার পরিষদ নামে একটি সংগঠনের সদস্য। সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল ট্রানজিট নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে, গত জুন মাসে তারা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।”
ওই ভিডিওতে ‘বিক্ষোভ সমাবেশে’র যে ব্যানার দেখা যাচ্ছে, তা থেকেও বিষয়টি বুঝতে আসলে কোনও অসুবিধা হয় না।
সোজা কথায়, ওই সব স্লোগানের পরিপ্রেক্ষিত ছিল প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারত সফরের সময় স্বাক্ষরিত একটি বিতর্কিত সমঝোতাপত্র – যার সঙ্গে কোটা আন্দোলনের কোনও সম্পর্কই নেই।
তবে এর পরেও উল্লিখিত বার্তা নিয়েই ভিডিওটি ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, ওই বিজেপি নেতাও তার পোস্টটি ডিলিট করেননি।
অন্যদিকে, ৩০শে জুলাই সকালে ‘ওয়কফ্লিক্স’ নামে ভারতের একটি ভেরিফায়েড (ব্লু টিক-ওলা) এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যাতে দেখা যায় দুজন বোরখা পরিহিত তরুণী স্কুটারে চেপে এসে ঢাকায় আন্দোলনকারীদের মাঝে পানির বোতল বিতরণ করছেন।
তবে ওই অ্যাকাউন্ট হোল্ডার এর সঙ্গে যে ধারাবিবরণীটি যোগ করেন, সেটাই ছিল চরম আপত্তিকর।
তিনি বলেন, ওই দু’জন বোরখাপরিহিত তরুণী আসলে কোটা আন্দোলনকারীদের ‘দাঙ্গায় উৎসাহ দিচ্ছেন’ এবং যে নারীরা বোরখা পরেন না, তাদের ‘ধর্ষণ করতে মদত দিচ্ছেন’।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাক্টচেকিং সাইট ‘অল্ট নিউজ’ এই পোস্টটিকে ‘সাম্প্রদায়িকতার বার্তাবাহী’ বলে চিহ্নিত করেছে।
তারা আরও জানিয়েছে, এই ভিডিওটি ঢাকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে কোটা আন্দোলনের সময় তোলা ঠিকই, কিন্তু এটি আসলে “ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে বিভ্রান্ত করতে পোস্ট করা হয়েছে।”
এদিকে গত ২০শে জুলাই ‘পাকিস্তান রেজিস্ট্যান্স’ ও ‘পাকিস্তান ফার্স্ট’ – এই ধরনের নামের একাধিক হ্যান্ডল থেকে পোস্ট করে দাবি করা হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সাহায্য চেয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক কোম্পানি ভারতীয় সেনা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ঢাকায় প্রবেশ করেছে।
সঙ্গে ঢাকার উপকণ্ঠে রাস্তায় একটি সেনা বহরের ছবি দিয়ে এই বক্তব্য সত্যি বলেও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি হ্যান্ডল থেকে একই ধরনের বক্তব্য জানানো হয়।
‘ডিফ্র্যাক’ নামে দিল্লির একটি তথ্যানুসন্ধানী টিম দেখিয়েছে, এই দাবি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং বাংলাদেশের ওই সংকটের মুহূর্তে আসলে ভারতের কোনও সৈন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি।
গত ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।
ওই বৈঠকের একটি ছবিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়, যাতে উপস্থিত একজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে কোনও কোনও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, “এত গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার কেন?”
এই পোস্টটিও ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে – যার পরে ভারতের ‘দ্য কুইন্ট’ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি আদৌ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত নন, বরং প্রধানমন্ত্রী হাসিনারই নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী।
গত পনেরো দিনের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে এই ধরনের কত বিভ্রান্তিকর পোস্ট ও ‘ফেক নিউজ’ যে ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।