ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :চার দেয়ালে বদ্ধ স্টেডিয়ামে গতানুগতিক উদ্বোধনের বাইরে গিয়ে এক অভিনব কায়দায় অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনের আয়োজন করবে প্যারিস- এ নিয়ে বিশ্বের তুমুল আগ্রহ। প্যারিস কর্তৃপক্ষ মূলত কী আয়োজন করতে যাচ্ছে? ৩০০০ ড্যান্সার, ৯৪টি নৌকা এর সিন নদী- মিলেমিশে এককার হয়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে প্রস্তুত ছিল পুরো বিশ্বই।
প্যারিসের ঐতিহাসিক সিন নদীতে শুক্রবার রাতে নাটকীয় এবং অভিনব এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানই হয়ে গেলো। উদ্বোধন হলো অলিম্পিক গেমসের ৩৩তম আসরের। যে অনুষ্ঠানকে ঘিরে সারা বিশ্বের ছিল তুমুল আগ্রহ। সে প্রত্যাশা পূরণ তো করলই, নতুন এক দিগন্তও খুলে দিয়ে গেলো ক্রীড়া উদ্বোধনের ক্ষেত্রে।
স্টেডিয়ামের বদ্ধ পরিবেশে উদ্বোধন করার চেয়ে, প্যারিস দেখিয়ে দিল, উদার মনোভাব এনে মনের জানালা-দরজাগুলোকে খুলে দাও। ভয়কে জয় করো। কে বলবে, এই প্যারিসই আতঙ্কের শহর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল গেমসের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে। সব দূরে ঠেলে দিয়ে সিন নদীর তীরে বসে সেই জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখলো প্রায় ৫ লাখ মানুষ।
এতদিন অলিম্পিকের উদ্বোধন মানেই ছিল স্টেডিয়ামের ভেতরে জমকালো অনুষ্ঠান। সে সঙ্গে পতাকা হাতে খেলোয়াড়দের প্যারেড। আয়োজক দেশ নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় ওই অনুষ্ঠানে।
তবে প্যারিস যে এবার সেই পুরোনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তা জানিয়েছিল আগেই। সবার ভাবনা ছিল, কী চমকটাই না দেখায় তারা। সবচেয়ে বড় চমক দেখানো হলো, সিন নদীতে অ্যাথলেটদের নৌকায় করে নিয়ে আসা।
৯৪টি ছোট-বড় নৌকায় করে এলেন ২১১টি দেশের অ্যাথলেটরা। সিন নদীর বুকে খেলোয়াড়দের প্যারেডের সঙ্গে তীরে দু’পাশে হলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কখনো গাইলেন লেডি গাগা, কখনো পরিচয় করানো হলো প্যারিসের সংস্কৃতির সঙ্গে; কিন্তু এই সব কিছু যখন ঘটছে, তখন অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজেছে প্যারিস। যার প্রভাব পড়ল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ওপরেও।
বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হয় প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুতে ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ফুটবলার জিনেদিন জিদানের হাতে ছিল অলিম্পিকের মশাল। যা তিনি তুলে দেন তিন শিশুর হাতে। তাদের হাত থেকে সেই মশাল চলে যায় এক অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে।
পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে তার মুখ ছিল ঢাকা। যে সময় অনুষ্ঠান শুরু হয়, তখন ফ্রান্সে বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো রয়েছে; কিন্তু মেঘলা আকাশের কারণে রংহীন মনে হচ্ছিল ভালোবাসার শহরকে। চার ঘণ্টার অনুষ্ঠানের শেষের দিকে অন্ধকার হওয়ার পর আলো জ্বালিয়ে দেয়াও হয়। তাতে এক মায়াবী ছবি তৈরি হলেও বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া খেলোয়াড়রা তখন বেশ ক্লান্ত। বিভিন্ন দেশের অতিথিরা এসেছিলেন অলিম্পিকের উদ্বোধনে। লম্বা অনুষ্ঠান শেষে তাদের মুখেও তখন বিরক্তির ছাপ।
পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নদীতে হওয়ার কারণে সব অনুষ্ঠান সবাই দেখতে পায়নি। প্যারিস শহরের বিভিন্ন স্থাপত্যকে তুলে ধরা হয় এসব অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেসব সম্প্রচারকারী সংস্থা টিভিতে দেখাতে পারলেও সিন নদীর তীরে বসে থাকা দর্শকদের ভরসা ছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। সামনে দিয়ে ভেসে চলেছে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নৌকা। কোন দিকে চোখ রাখবেন তারা, তা বোঝা ভার।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খেলোয়াড়দের প্যারেডের শুরুতে পানি দিয়ে বিশেষ পর্দা তৈরি করা হয়েছিল। সেই পর্দা ভেঙে প্রথমে এগিয়ে এলো গ্রিস। পন্ট ডি’এলিনা ব্রিজের তলা দিয়ে বেরিয়ে এলো তারা। এরপর এলো উদ্বাস্তুদের অলিম্পিক দল। এরপর আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, জার্মানি একটি বড় নৌকা করে একই সঙ্গে এলো। একে একে বিভিন্ন দেশের নৌকা যখন ওই পানির পর্দা ভেদ করে এগিয়ে আসছে, সেই সময় অন্য দিকে গান গাইছেন লেডি গাগা।
প্যারেডের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সিন নদীর ধারে। একই সঙ্গে টিভিতে বা বড় পর্দায় যারা দেখছেন, তাদের জন্য বিশেষ তথ্যচিত্র দেখানো হয়। নটরডেমের সামনে পারফর্ম করল মুল্যাঁ রুজ। ১৮২০-এর দশকে সৃ্ষ্টি হওয়া একটি বিশেষ নাচ ফিরিয়ে আনলো তারা। ফরাসি ভাষা জানা শিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় শিল্পী আয়া নাকামুরা পারফর্ম করলেন। তার সঙ্গে রিপাকলিকান গার্ডের বাদ্যযন্ত্রী এবং ফরাসি সেনার শিল্পীরা সঙ্গীত করলেন।
পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে অনেক কিছুই হলো। কিন্তু কোনটা ছেড়ে, কোনটা দর্শক দেখবে তা বোঝা ছিল কঠিন। কিছু কিছু অনুষ্ঠান তো দেখাই সম্ভব নয়। কারণ মাঝ নদীতে হওয়া ফ্যাশন শো, নাচ দেখার জন্য ভরসা জায়ান্ট স্ক্রিন। লাখ লাখ টাকা দিয়ে টিকিট কাটলেও নদীর মাঝে কী ঘটে চলেছে তা তীর থেকে বসে দেখা সম্ভব ছিল না।
বর্ণক্রম অনুসারে খেলোয়াড়দের প্যারেড হওয়ায় একেবারের শুরুর দিকেই দেখা যায় বাংলাদেশের অ্যাথলটদের বহনকারী নৌকা। আরচার সাগর ইসলাম বহন করেন বাংলাদেশ দলের পতাকা। বৃষ্টির কারণে অনেকেই বর্ষাতি পরে ছিলেন।
বিভিন্ন দেশের নৌকা যখন সিন নদী ধরে এগিয়ে চলেছে, তখন ফ্রান্সের অন্যতম সেরা সংগ্রহশালা, প্রদর্শনী স্থল গ্রাঁ প্যালাই থেকে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন অ্যাক্সেল সাঁ-সিরেল। ফ্রান্সের ইতিহাসে ১০ জন সবচেয়ে বিখ্যাত নারীর ভাস্কর্য উন্মোচন করা হলো। সঙ্গে বর্ণনা করা হলো তাদের কৃতিত্ব।
প্যারেডের শেষ তিন দেশ হিসাবে পরপর এলো অস্ট্রেলিয়া (২০৩২ অলিম্পিকের আয়োজক), আমেরিকা (২০২৮ অলিম্পিকের আয়োজক) এবং ফ্রান্স (এবারের আয়োজক)। ফ্রান্সের নৌকাটি ছিল বাকি সবার চেয়ে আলাদা।
ফ্রান্সের নৌ যখন এগিয়ে এলো, আইফেল টাওয়ার আলোয় ঝিকমিক করে উঠল, যা দেখতে ছুটে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত মনে হলো, আইফেল টাওয়ারের নিচ থেকে আয়রন ঘোড়ায় করে বেরিয়ে আসা অজানা এক নারী। যার গায়ে অলিম্পিকের পতাকা জড়ানো। আইফেল টাওয়ারকে ‘আয়রন লেডি’ বলা হয়। ইনিও কি ছিলেন তাই?
চমক তৈরির চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি ফ্রান্স। দেশগুলোর প্যারেড শেষ। এবার একের পর এক বিশেষ নৌকা এগিয়ে আসছে। কোনোটিতে চলছে ফ্যাশন শো, কোনোটিতে নাচগান। ফ্রান্সের বিভিন্ন সংস্কৃতি তুলে ধরা হচ্ছে সেই সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শেষবেলায় যা কিছুটা নজর কাড়ল টিভিতে চোখ রাখা দর্শকদের।
আইফেল টাওয়ারের নিচে বিরাট সংখ্যক দর্শক তখন অপেক্ষা করছিলেন। তাদের সামনে উড়ল অলিম্পিকের পতাকা, গাওয়া হলো প্রতিযোগিতার থিম সং। সেখানে প্যারিস অলিম্পিক্স আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্তাঙ্গুয়েদ এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান থমাস বাখ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সব খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানান। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্যারিস অলিম্পিকের সূচনা করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অলিম্পিক্সের মশাল হাতে নেন জিনেদিন জিদান। সেই সময় সবচেয়ে তীব্র হলো সিন নদীর তীরে বসে থাকা দর্শকদের গর্জন। জয়ধ্বনি উঠল, ‘জিজু, জিজু, জিজু’। তখনই শুরু হয়ে গেলো লেজার শো। আলোর ঝরনায় আরও মায়াবী করে তোলা হলো আইফেল টাওয়ারকে।
জিদানের হাত থেকে মশাল নেন ফ্রেঞ্চ ওপেনের কিংবদন্তি নায়ক রাফায়েল নাদাল। নৌকায় করে সেই মশাল নিয়ে সিন নদীর ওপরে দেখা যায় নাদাল, সেরেনা উইলিয়ামস, কার্ল লুইসকে।
আইফেল টাওয়ার জুড়ে আলোর খেলা দেখা যায়। ফ্রান্সের বিভিন্ন তারকাদের হাতে ঘুরল অলিম্পিকের মশাল। শেষে গান গাইলেন সেলিনে ডিয়ন। ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও গান গেয়েছিলেন তিনি।
আয়োজক কমিটির প্রধান, রোয়িং কিংবদন্তি এস্তাঙ্গুয়েদ মন মাতান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতোই হৃদয় জিতে নেওয়া বক্তব্য দিলেন। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বকে আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম যে, এটা প্যারিস। এখানে সব দেশের মানুষ স্বাগত। সব ধর্ম স্বাগত। সবসম্প্রদায় স্বাগত।’
প্রতিযোগীদের উদ্দেশে বললেন, ‘প্যারিস ভালোবাসার শহর। আর আগামী কয়েকদিন এটা তোমাদের শহর। কাল থেকে তোমাদের জয় আমাদের জয়, তোমাদের পরাজয় আমাদের পরাজয়।’