ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :একমাসের মধ্যে টানা তিন দফা বন্যার কবলে সিলেট। গত ২৭ মে প্রথম দফা, ১৭ জুন দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দেয়। এ দুই দফা বন্যার রেশ না কাটতেই ১ জুলাই থেকে সিলেটে ফের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উপর্যুপরী বন্যায় দিশেহারা অবস্থা সিলেটের মানুষের।
এর আগে ২০২২ সালে অন্তত তিন দফা বন্যা হয় সিলেটে। এরমধ্যে ২০২২ সালের জুনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট জেলার অন্তত ৮৫ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। আর পুরো বিভাগে তলিয়ে যায় প্রায় ৭৫ ভাগ এলাকা।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সিলেটে সব সময়ই ভারী বৃষ্টিপাত হয়। আর সিলেটের উজানেই অবস্থান এশিয়ার সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির। সেখানেও সারা বছরই বৃষ্টি লেগেই থাকে। অতিবৃষ্টি সত্ত্বেও আগে সিলেটে এমন ঘন ঘন বন্যা হয়নি। ফলে ইদানিংকালে সিলেটে বারবার বন্যা সৃষ্টি হওয়ায় তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার বন্যা তীব্র আকারও ধারণ করছে।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সিলেটে প্রধান নদীগুলোর বিশেষত সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, সিলেট নগরী ও নগরীর আশপাশের এলাকার পুকুর দিঘি, হাওর ভরাট ও দখল করে ফেলা, হাওর এলাকায় অপরিকল্পিত স্থাপনা এবং সিলেটের উজানে মেঘালয়ে অল্প সময়ে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণেই সিলেটে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে।
সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবুল মোমেনও এসব কারণকেই সাম্প্রতিককালের বন্যার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, সিলেটে এ মৌসুমে সব সময়ই ঢল নামে। আমাদের ছেলেবেলায়ও এমনটি দেখেছি; কিন্তু তখন পানি আটকে থাকত না। চলে যেত। কারণ আমাদের শহরে অনেক পুকুর ও দীঘি ছিল। প্রত্যেক বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। আর সিলেটকে বলা হতো দীঘির শহর। কিন্তু এখন আমরা নগরের ভেতরের সব পুকুর, দীঘি ভরাট করে বড় বড় বিল্ডিং করেছি। হাওরগুলো ভরাট করে ফেলেছি। এ ছাড়া প্রধান নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। খালি মাঠগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে পারছে না। যেকোনো দুর্যোগেই সিলেটের জন্য এটা একটা ভয়ের কারণ।
নদীর তলদেশ ভরাট:
সিলেটের প্রধানতম নদী সুরমার দুই রূপ। বর্ষায় দুকূল উপচে ডুবিয়ে দেয় জনবসতি। আর গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে পরিণত হয় মরা গাঙে। জেগে ওঠে চর। প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা দেশের অন্যতম দীর্ঘ নদী। ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে এ নদী। দীর্ঘ হলেও এ নদী বছরের বেশির ভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায়।
এর কারণ, পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে এ নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অন্যদিকে, অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
জানা যায়, ভরাট হয়ে পড়েছে এ নদীর উৎসমুখও। নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর। দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আটকে আছে উৎসমুখ খননও।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সুরমা নদীর উৎসমুখ খননে ২০১২ সালে সিলেট থেকে একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেওয়ার কথা সে সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। তবে এরপর এ ব্যাপারে আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অবশ্য ২০১৮ সালে সিলেট সদর উপজেলার কানিশাইলে ৬০০ মিটার সুরমা নদী খনন করা হয়। এ সময় সিলেট সদর উপজেলা এবং কানাইঘাট উপজেলার কয়েকটি অংশে নদী খননের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করা হয়; কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
এরপর ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট নগরীর কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়। এ ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি।
তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির মৌসুমে নদী উপচে পড়ে পানি। ভরাট হয়ে গেছে সিলেটের অন্য প্রধানতম নদী কুশিয়ারাও। এ দুই নদী খনন ছাড়া বন্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে আছে। এ ছাড়া নাগরিক বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য সুরমা নদীর তলদেশে শক্তভাবে বসে আছে। এ কারণে নদী পানি ধারণ করতে পারছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, চলমান প্রকল্পটির অন্তত ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। পানি কমলে বাকি কাজ দ্রুত শেষ হবে। তিনি বলেন, এ এলাকার বেশির ভাগ নদীই নাব্য হারিয়েছে। এগুলো খনন করা প্রয়োজন।নগরীর জলাশয় ভরাট ও দখল:
সাগরদিঘির পাড়, লালদিঘির পাড়, রামেরদিঘির পাড়-সিলেট নগরীর অন্তত ২০-২৫টি এলাকার নাম এরকম। দিঘির নামে এলাকার নাম ঠিকই আছে; কিন্তু দিঘিগুলো নেই। ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। গত তিন দশকে ভরাট হয়ে গেছে নগরীর অর্ধশতাধিক দিঘি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসেবে, ১৫-২০ বছর আগেও সিলেট নগরে অর্ধশতাধিক বৃহৎ দিঘি ছিল। অথচ এখন টিকে আছে ১০-১১টি। বাকিগুলো ভরাট হয়ে গেছে।
আর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হিসেবে, সিলেট নগরীর পুকুর, দিঘি মিলিয়ে তিন শতাধিক জলাশয় ছিল। এর দুই-তৃতীয়াংশই ভরাট হয়ে গেছে। অনেক জলাশয় ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।
এ ছাড়া সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে ছোট-বড় প্রায় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল। যা ছড়া নামে পরিচিত। পাহাড় বা টিলার পাদদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে ছড়াগুলো গিয়ে মিশেছে সুরমা নদীতে। এসব ছড়া দিয়েই বর্ষায় পানি নিষ্কাশন হতো। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। এখন অনেক স্থানে এসব ছড়ার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়াগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৩টি বড় ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরেই এসব ছড়ার দুই পাশ দখল করে রেখেছে স্থাপনা নির্মাণ করেছে অবৈধ দখলদাররা।
এ ছাড়া নগরের উপশহর এলাকার হাওর ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। বাঘা এলাকার হাওর ভরাট করে হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট।
জলাধারগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় নগরের পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখন বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর ঢল নামলে বন্যা হয়ে যায়।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার ছড়া উদ্ধার করেছি। এতে নগরীতে আগের মতো আর জলাবদ্ধতা হয় না। অধিক বৃষ্টিতে নগরীতে কিছু এলাকায় পানি জমলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা নেমে যায়।
তিনি বলেন, আমরা নগরের জলাশয়গুলো রক্ষায়ও বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আর কোনো জলাশয় ভরাট করতে দেওয়া হচ্ছে না।
উজানে অতিবৃষ্টি:
সিলেটে বর্ষাকাল সবসময়ই দীর্ঘ হয়। এ সময়কালে বৃষ্টি লেগে থাকে। আর সিলেটের উজানেই অবস্থান সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির। সম্প্রতি উজানে এক দিনে অতিভারী বৃষ্টির প্রবণতা বেড়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার, নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ভারতের ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিওরোলজি এবং বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় বলা হয়, গত চার দশকে ভারতের মেঘালয়-আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকলেও এক দিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা চারগুণ বেড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টাচ্ছে, যা সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।