ইউকে শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
হেডলাইন

হাজার কোটি টাকা লুকাতে এনবিআর প্রথম সচিবের ৭শ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট!

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :আয়করদাতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বদলি বাণিজ্য, দাপ্তরিক বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানাবিধ অপকর্মের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব (কর) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। অপরাধলব্ধ এসব সম্পদ লুকানোর উদ্দেশে তিনি আত্মীয়-স্বজনের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৭শ অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এমন ধারণা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। আদালতের নথিসূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যেই ১৯টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ফয়সাল ও তার স্ত্রী-স্বজনের নামে থাকা একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট এবং ৮৭টি ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র মিলে শতকোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বৃহস্পতিবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এসব সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। এর মধ্যে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট ফয়সালের নিজের নামে কেনার পাশাপাশি, স্ত্রী আফসানা জেসমিন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী, শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে গড়েছেন অধিকাংশ সম্পদ। এ ছাড়াও ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসান, শ্যালক আফতাব আলী, শ্যালিকা ফারহানা আফরোজ, খালাশাশুড়ি মাহমুদা হাসান, মামাশ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিন, আত্মীয় খন্দকার হাফিজুর রহমান ও রওশন আরা খাতুনের ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য আদালতে তুলে ধরে দুদক।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে ২০২২ সাল থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে তার শতকোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে তার নামে আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু এখনো অনুসন্ধান চলমান, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মোট কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা বলা যাবে না।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, এনবিআর কর্মকর্তা ফয়সাল বিদেশে কয়েকশ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ছাড়াও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।

দুদক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ফয়সালের নামে ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা জমা হয়। তার স্ত্রী আফসানা জেসমিনের ৫টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ও শাশুড়ি মমতাজ বেগম গৃহিণী হলেও তাদের ব্যাংক হিসাবে সবচেয়ে বেশি লেনদেনের সন্ধান পায় দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হয় এবং পরে এর বড় অংশ উত্তোলন করা হয়। ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর ৮টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। তার নামের ৮টি ব্যাংক হিসাবের দুটি ২০০৭ ও ২০১০ সালে খোলা এবং বাকিগুলো খোলা হয় ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে। ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ১০টি ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি টাকা জমা হয়। তার নামের ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে একটি ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে খোলা হয়। এদিকে ফয়সালের শ্যালক আফতাব আলীর ৬টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জমার তথ্য পেয়েছে দুদক। তাদের নামে বিভিন্ন সময়ে এসব টাকা জমা হয়েছে। পরে এর বড় অংশই তুলে নেওয়া হয়েছে। ফয়সাল, তার স্ত্রী, শ্বশুর ও স্বজনদের নামে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও রয়েছে।

শ্বশুরের ফ্ল্যাটে বসবাস!

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী সড়কের ৮৫ কাঠার ওপর নির্মিত রূপায়ণ স্বপ্ননিলয় ভবনের একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করেন ফয়সাল। পার্কিংসহ ৩ হাজার ২২৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি গত বছরই শ্বশুর আহম্মেদ আলীর নামে কিনেছেন। এ ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য প্রায় ছয় কোটি টাকা। যদিও দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

২০২০ সালে রাজধানীর ভাটারার কাঁঠালদিয়া মৌজার বসুন্ধরা এলাকায় ফয়সাল তার স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে ৫ কাঠার একটি প্লট কেনেন। সাড়ে তিন বছর আগে ওই জমির দলিলমূল্য ১৮ লাখ ১৭ হাজার টাকার দেখানো হলেও এখন সেই জমি কাঠা প্রতিই এক কোটি টাকার কাছাকাছি। বসুন্ধরার আবাসিক প্রকল্পের মধ্যে ফয়সাল নিজের নামে আড়াই কাঠা জমি কেনেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ফয়সাল নিজ নামে আলাদা ৪টি দলিলে জমি কিনেছেন। এসব সম্পদের দলিলমূল্য দেখানো হয় ৪০ লাখ টাকার বেশি।

অন্যদিকে শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ২০২২ সালে রাজধানীর আফতাবনগরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ১০ কাঠার একটি প্লট কিনেছেন ফয়সাল। এই প্লটের দলিলমূল্য ৫২ লাখ টাকা হলেও বর্তমান বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।

ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে দায়িত্বরত দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল আমাদের সময়কে বলেন, ফয়সালের যেসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ৩৩ দপ্তরে আদেশের অনুলিপি পাঠিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই আইনজীবী জানান, আদালত তার আদেশে ক্রোককৃত ফ্ল্যাট-প্লট-জমিসহ স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর যাতে না করা যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন করা যাবে না, তবে জমা করা যাবে বলে আদেশ দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, মাহমুদ ফয়সাল ২০০৫ সালে বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। তিনি বর্তমানে এনবিআরের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।

ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত এনবিআরের সদ্যবিদায়ী সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের মধ্যেই ফয়সালের সম্পদ জব্দের চাঞ্চল্যকর খবর এলো। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুবক মুশফিকুর রহমান ইফাত ভাইরাল হওয়ার পর পরিচয় খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে তার বাবা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর। এরপর গত ২৩ জুন মতিউরকে ট্রাইব্যুনাল থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওই দিনই তার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি করে দুদক।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ