ইউকে রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
হেডলাইন

বন্দি খাঁচায় কাটে বৃদ্ধাশ্রমের উৎসব-আনন্দ

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : স্বামী যখন মারা যান তখন মেয়ে দুটো অনেক ছোট। আমার আঁচল ধরে বের হতো। কোথাও গেলে আঁচল ধরে থাকত। ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরেকজন বুয়েটে। বিয়ে করে দুজনে বিদেশে গেল। আর ফিরে এল না। ২০ বছর আমি একা। ওরা হয়ত আমার মৃত্যুর খবরে আসবে। নাতি-নাতনিরা হয়ত আমার চারিদিকে কাঁদবে। তখন আমি থাকব না।

বিষণ্ণ মনে কথাগুলো বলছিলেন সমাজসেবা অধিদফতরের সাবেক উপপরিচালক ষাটোর্ধ্ব সোয়ালী আক্তার। স্বামীর মৃত্যুর পর চাকরির শেষ সম্বল দিয়ে দুই মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছেন তিনি।

ছোট মেয়ে বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্বামীর সাথে পাড়ি জমিয়েছেন ইতালিতে। বড় মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে চলে গেছেন ইতালি। এখন তিনি একা, স্বামীর উপহারের বাড়িটি ভেঙে ফেলতে হয়েছে সোয়ালী আক্তারকে। বয়সের ভার আর সব হারিয়ে আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা এখন সোয়ালী আক্তার।

সোয়ালী আক্তারের মত জীবনের গল্পটা একই রকমের সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের। জীবনের সবটুকু দিয়ে দুই ছেলেকে করেছেন শিক্ষিত। এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। ছোট ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রফেসর। দুই ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলেও বৃদ্ধ নুরুল ইসলামের ঠাঁই হয়েছে প্রবীণ নিবাসে। এখন চাকরির পেনশনের টাকাই নুরুল ইসলামের শেষ সম্বল। মরার পরে দাফন কোথায় হবে সেটাও জানেন না ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ।

শুধু সোয়ালী আক্তার ও নুরুল ইসলাম নয়। আগারগাঁওয়ের এই প্রবীণ নিবাসে জীবনের এমন করুণ ইতিহাস নিয়ে বসবাস করছেন ৩৫ জন বৃদ্ধ মা-বাবা। তাদের মধ্যে কেউ নিজ ছেলে-মেয়ে দ্বারা প্রতারিত। কেউবা প্রিয়জনের অবহেলা আর তিক্ততায় নির্বাসিত।

রোববার (৩০ মার্চ) সরেজমিন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধের সাথে। ঈদ কেমন কাটে, তাদের চাওয়া; জানতে চাইলে জানান, বন্দি খাঁচায় চিড়িয়াখানার পশুপাখির যেমন কাটে, তেমনি কাটে আমাদেরও উৎসব-আনন্দ।

আক্ষেপের সঙ্গে তারা বলেন, নির্বাসিত এ জীবনে তাদের চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের মতই তাদের জীবন। নিঃসঙ্গ জীবন কারও কারও অভিশাপ। মৃত্যুই তাদের পরিত্রাণ। উৎসব, ঈদ আনন্দ এই প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের কাছে বিষাক্ত তীরের মত, যে তীর আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দুঃখের সাগরে ভাসায়। তবে অভিযোগ নেই তাদের।

আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসের আরেক বাসিন্দা নাদিরা বেগম। আশির দশকে বাবা মায়ের বাধ্য হয়ে প্রিয়জন ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। কিন্তু বাবার পছন্দের সে ঘরে বেশিদিন টিকতে পারেননি নাদিরা। স্বামীর অত্যাচার ও নিপীড়নে নিতে হয়েছে বিচ্ছেদ। পরে বিশ্বাস করে হাত ধরেছিলেন আরেকজনের। মৃত্যুর ডাকে বেশিদিন তিনিও আগলে রাখতে পারেননি নাদিরা বেগমকে। বাবার সম্পত্তির ভাগ না পেয়ে ভাইয়ের প্রতারণার শিকার হয়ে নাদিরা আজ নির্বাসিত। যৌবনে যেমন সুখ খুঁজে পাননি তিনি, শেষ বয়সেও একই সংকটে।

নাদিরা বেগম বার্তা২৪.কমকে বলেন, সমাজ থেকে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। সমাজ থেকে অপমান, ধিক্কার আর লাঞ্ছিত হতে হতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার সময় কাটে লেখালেখি করে, টিভি দেখে। ভাই প্রতারণা না করলে হয়ত আমার জীবন এমন হতো না। সন্তানরাও সৎ মায়ের খোঁজ নেন না। তবে আক্ষেপ নেই। সবার প্রতি অনুরোধ বোনের প্রতি সদয় হবেন। বাবা-মায়ের যত্ন নেবেন।

এদিকে, এখনো সন্তানদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন সোয়ালী আক্তার। একাকী জীবনে বৃদ্ধাশ্রমেই তার ভালো কাটে জানিয়ে সোয়ালী আক্তার বলেন, ঈদের দিন ফোন করি মেয়েদের। তারা বলে আমরা তো ব্যস্ত মা। পরে কথা বলব। সন্তানরা বড় করতে কী কষ্ট তা বোঝানোর ভাষা নাই। পৃথিবীতে মায়া মমতা কমে গেছে। বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধও কমে গেছে।

একই কথা সাবেক ব্যাংকার নুরুল ইসলামেরও। তিনি বলেন, পৃথিবীতে বন্ধন বলতে কিছু নেই। মায়ামমতা সব হারিয়ে গেছে। আমার দুই ছেলে তো প্রতিষ্ঠিত। অনেক টাকা বেতনও পায়। তারা কি পারত না আমার দায়িত্ব নিতে? পারত। যুগ পাল্টেছে। বিশ্বের আধুনিক দেশের মতই আমাদের দেশের কালচার হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে, যা আগামীর জন্য ভয়ংকর।

জীবনের করুণ এই সংকটে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়েছে প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের। তাই সবার চোখের আড়ালেই থাকতে চান তারা। নির্মমতার আঘাতে ভাঙতে-ভাঙতে এই নিবাসের বেশিরভাগ মানুষ এখন প্রহর গুনছেন মৃত্যুর। তবে বৃদ্ধাশ্রমের সেই দৃশ্য কি কখনো হার মানবে না? নাকি যুগের পরিক্রমায় নচিকেতার গানের সেই আক্ষেপ আর অভিযোগই হবে নিয়ম; নাকি প্রতিষ্ঠিত হবে মায়ামমতা বিহীনদের দায়িত্বহীন সমাজ? সৌজন্যে: বার্তা ২৪

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com