ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : ‘হাইছা শাক, কচু আর ভাত এই হলো সেহরি ও ইফতারের খাবার। ভাগ্য ভালো হলে আলু কিংবা ডাল-ভাত। রমজানে এটাই ওদের স্পেশাল খাবার। ৮ সদস্যের পরিবারের রোজগার মাত্র একজন। দৈনিক যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়ে পরিবারে সদস্যদের আহারের ব্যবস্থাও কষ্টকর। এই রমজানের দিনে একটু ভালো খাওয়া সেটা কেবল স্বপ্ন। দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যোগাড় করাও কষ্টকর। বাবারে আমাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা তো খেয়ে না খেয়ে মরে মরে বাঁচি।’ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একনাগাড়ে তাদের চলমান জীবনযুদ্ধের কষ্টের কথাগুলো জানালেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের সুজনগর গ্রামের মৃত আবরুস মিয়ার স্ত্রী ময়না বিবি (৭০)। তার এই জীবনযুদ্ধে মানবেতর জীবনযাপনের বাস্তবিক গল্পের মতো একই চিত্র পুরো গ্রাম জুড়ে।
গ্রাম ঘুরে নানা বয়সী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুর্দিনের বাস্তবিকতা। তারা আয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই ব্যয় কুলাতে পারেন না। তাই নুন আনতে পানতা ফুরায়। ঊর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্য এখন সব স্বস্তিই কেড়ে নিয়েছে তাদের মতো নিম্নআয়ের গাঁও-গেরামের মানুষের। পরিবারের একমাত্র আয় রোজগারের কর্মক্ষম পুরুষ ব্যক্তিটির দুশ্চিন্তায় রাত-দিন একাকার। সন্তানদের পড়ালেখা, খাবার, চিকিৎসা, বস্ত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের জোগান ও বেঁচে থাকার কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ভয়ে দিশাহারা বাবা-মা। দিনদিনই কেবল বাড়ছেই জিনিসপত্রের দাম।
সাধ্যের মধ্যে থাকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যটিও রমজানে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দেয়ায় তাও এখন নাগালের বাইরে। এমনটিই জানালেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মুনুমুখ ইউনিয়নের সুজননগর ও মনুমুখ সুমারাই গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ। মনু ও কুশিয়ারা নদীর মিলন মোহনার তীরে এই দু’টি গ্রামের অবস্থান। গ্রাম দু’টির অধিকাংশ মানুষই মৎস্যজীবী। জানা গেল সুজননগর গ্রামে ৮০টি পরিবারে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক। আর মনুমুখ সুমারাই গ্রামে ১৫০ পরিবারে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ শতাধিক। প্রতিটি পরিবারে শিশুর সংখ্যাও কম নয়। আয় রোজগারের মানুষ পরিবারে এক থেকে দুইজন। গ্রাম দু’টি জেলেপল্লী হিসেবেই পরিচিত। মাছধরা আর বিক্রি তাদের পেশা। নদী ও হাওরে গেল বছর মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাছের উৎপাদন কম হয়। এরই রেশ এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া নানা কারণে এখন নদী ও হাওরে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা মাছ কম থাকায় ভালো নেই তাদের আয় রোজগার। রাতদিন মাছ ধরার জাল টেনে মিলে কোনোদিন ২/৩শ’ টাকা। কোনোদিন এর চেয়ে কিছু কম কিংবা বেশি। আর এখন অনেক দিন খালি হাতেও ফিরতে হচ্ছে।
সুজননগরের আব্দুল মন্নান, ফুল মিয়া, আপ্তাব উদ্দিন ও ছুরুক মিয়া আর মনুমুখ সুমারাই গ্রামের শাহ আলম ও আফজলসহ অনেকেই জানালেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা আয় রোজগার দিয়ে কুলাতে পারেন না। আগের মতো নদী ও হাওরের মাছ না থাকায় রাতদিন জাল টেনে আশানুরূপ মাছও পাওয়া যায় না। তাই আর্থিক চরম সংকটে পরিবারে সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা করাও কঠিন হচ্ছে দিন দিন। ধারদেনা ও নানা এনিজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছেন। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবেন এমন দুশ্চিন্তায় তাদের রাতদিন একাকার। তারা অভিযোগ করে জানালেন জেলে কার্ড থাকলেও কোনোদিনও তারা সরকারি তরফে কোনো সহযোগিতা পাননি। গ্রাম জুড়ে স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথাও জানান তারা। মনুমুখ সুমারাই গ্রামের বিধবা নাজমা বেগম জানান- তার ৩-৭ বছরের ২ ছেলে ১ মেয়ে।
পরিবারের একমাত্র রোজগার স্বামী ইনসান মিয়াকে হারিয়ে অসহায়। এখন মানুষের সাহায্য সহায়তা পেয়েই দিন চলে তার। তিন সন্তান নিয়ে ভাঙা ঘরে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকম দিন পার করছেন। গতকাল বিকালে নিজ বসতঘরের উঠানে বিশেষ চুলায় শুকনোপাতা ও খড়কুটো জ্বালিয়ে রান্না করার সময় সুজননগরের রেশনা বেগম, রাশেদা বেগম, লাইলী আক্তার, সুফিয়া বেগমসহ অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানালেন- ‘হাইছা, কচু, আলু ও ডাল এই হচ্ছে রমজানে তাদের স্পেশাল খাবার।’ তারা জানালেন- তাদের গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জন। আর বেশির ভাগই পরিবারই একজনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই যেদিন রোজগার হয় না সেদিন ভাতও থাকে না। রমজান মাসে তারা ধারদেনা ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোনো রকম নিয়ম রক্ষা করে সেহরি ইফতার সারছেন। যে হারে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে আর অন্যদিকে আয় রোজগারে ভাটা পড়ছে, তাতে রমজান গেলে খাবার, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা ও চিকিৎসা এসব কীভাবে চলবে এই চিন্তায় তারা দিশাহারা। তাদের সবারই দাবি দ্রব্যমূল্য কমানো আর নদী হাওরের মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসার। সৌজন্যে: মানবজমিন