ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :আহমেদাবাদে এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের নীল সমুদ্রে কি কেউ বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে? কে জানে! নয়তো সব কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাবে কেন। কেন চিৎকার-উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়বে না মোতেরা।
কেন নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হবে না নীল উৎসব। উত্তরটা বোধ হয় এতক্ষণে আপনারও জানা- ভারত বিশ্বকাপটা জিততে পারেনি।
উৎসবের শহর এখন সিডনি। আহমেদাবাদ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের মেলবোর্ন-অ্যাডিলেড-পার্থ। অথবা পুরো অস্ট্রেলিয়ায় এখন আনন্দের জোয়ার। এখন তাদের ‘হেক্সা’ মানে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয় উদযাপনের সময়। ভারতকে রোববার তারা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালে হারিয়ে দিয়েছে ছয় উইকেটে। ওখানে সেঞ্চুরি করে নায়ক ট্রাভিস হেড।
মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভের পথ ধরে চলা মানুষগুলোর এখন মনে বিষাদ, কলকাতা নিউমার্কেটের অবস্থাও হয়তো তাই। ধর্মশালার পাহাড়ি মায়াও কি আজ বিষাদ? সম্ভবত চেন্নাইয়ের সমুদ্রের বিচও একইরকম বিষণ্ন।
অথচ আজ রঙ লাগার কথা ছিল আলোর। অথচ আজ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম হওয়ার কথা ছিল রঙিন। নয় শহর হয়ে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে সেমিফাইনাল, কোথাও থামতে হয়নি রোহিত কোহলিদের; একটি ম্যাচেও হারেনি তারা। তাদের থামতে হলো এমন এক জায়গায় এসে- নীল উৎসবের সব প্রস্তুতিই নেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল যেখানে। এখন সম্ভবত রোহিত মাথাটা আকাশে তুলে একটা প্রশ্নই বারবার করছেন- প্রকৃতি কেন এত নিষ্ঠুর!
প্যাট কামিন্স শ্যাম্পেইন হাতে নিয়ে উৎসব করবেন যখন, তার হয়তো তখন এক আকাশ স্বস্তি। পেসার, অধিনায়কত্ব কি করতে পারবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এখন হয়তো কোথাও একটা বিশ্বকাপ ছবি টাঙিয়ে রাখতে পারবেন তিনি। তার জন্য কুর্নিশ জানাবেন ট্রাভিস হেডকে- অমন সেঞ্চুরি না করলে হয়তো তার নেতৃত্বগুণটা ইতিহাসে ঠাঁই পেতো না এভাবে।
এসবের আঁচ অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল টস হেরে করা ভারতের ব্যাটিংয়ের সময়টাতেই। প্রতাপশালী, দাপুটে ব্যাটিং লাইন-আপ ফিকে হয়ে আসে মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স আর জশ হ্যাজিলউডের সামনে। পিচটাকে ঠিকঠাক বুঝে এমন সব বল ছুড়লেন তারা, বেশির ভাগ ভারতীয় ব্যাটার উত্তরই খুঁজে পেলেন না তার।
এর শুরুটা হয়েছিল শুভমন গিলকে দিয়ে। স্টার্ককে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে আসেন মিড অনে দাঁড়ানো এডাম জাম্পার হাতে। ক্ষুব্ধ চোখজুড়া নিয়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরতে হয় ৭ বলে ৪ রান করে। যেটি হতে পারতো আরও আগেই। কোনো রান করার আগেই স্লিপে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন তিনি, স্রেফ বলটা ক্যারি করেনি বলে বেঁচে যান তখন।
গিলকে হারানোর ক্ষত পরে আরও বাড়ে রোহিত শর্মাও পাওয়ার প্লের ভেতরই ফিরে যাওয়ার পর। ম্যাক্সওয়েলকে তুলে মারতে গিয়ে বল তুলে দেন অনেকটুকু উপরে, কাভার থেকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন ট্রাভিস হেড। ব্যাট হাতে পরে আর এর আগে এই ক্যাচ নিয়ে ম্যাচের ভাগ্যও সম্ভবত বদলে দেন তিনি। তখনও অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার রানটা ঠিকঠাকই ছিল, ১০ ওভারে তারা করেছিল ৮০ রান।
শ্রেয়াস আয়ার আউট হওয়ার পর ভারতের ডাগ-আউটে বসে থাকা রাহুল দ্রাবিড়ের স্মৃতিতে সম্ভবত বারবার ২০০৩ নাড়া দিয়ে গেছে। সেবার তিনি ছিলেন ক্রিকেটার, বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরেছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ার কাছে। এবার তিনি কোচ, এখনও কি তেমন হবে? ৮১ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলার পর ওই দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করা খুব অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু এরপরই তাকে কিছুটা স্বস্তি এনে দেন লোকেশ রাহুল ও বিরাট কোহলি। এ দুজনের পঞ্চাশ ছাড়ানো জুটির ফাঁকে বিরাট কোহলি তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। পুরো বিশ্বকাপজুড়ে দুর্দান্ত খেলা এই ব্যাটারের রান প্রায় ছিল আটশ হওয়ার পথে, বাকি আর কারো নেই ছয়শও।
তবে কোহলিকে থামতে হয় অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে, বিশ্বকাপের রান আটকায় নব্বইয়ের বেশি গড় ও স্ট্রাইক রেটে করা ৭৬৫তে। প্যাট কামিন্স আগের দিন নিজের চাওয়া জানিয়েছিলেন, ‘চুপ’ করিয়ে দিতে চান এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষকে। কোহলিকে আউট করার পর এর বাস্তব অনুভূতিটাও পেয়ে যান তিনি। ৬৩ বলে ৫৪ রান করে কামিন্সের শর্ট বল কাট করতে গিয়ে ব্যাট থেকে গিয়ে কোহলির স্টাম্পে লাগে, রাহুলের সঙ্গে তার ৬৭ রানের জুটি ভাঙে তাতে।
কোহলি আউট হওয়ার পর দায়িত্বটা পড়ে লোকেশ রাহুলের ওপর। সেটি তিনি পালনও করছিলেন ঠিকঠাক। মাঝে তার সঙ্গী হয়ে ফিরে যান রবীন্দ্র জাদেজা। এরপরও রাহুলও এমন এক বলে ফেরেন, যেখানে তার আদতে করার ছিল না কিছুই।
স্টার্কের ওই বলে উইকেটরক্ষক ইংলিশের হাতে ক্যাচ দেন তিনি। ১০৭ বল খেলে স্রেফ একটি বাউন্ডারি হাঁকানো রাহুল করেন ৬৬ রান। তার বিদায়ের পর সব আশাই ছিল সূর্যকুমার যাদবকে ঘিরে। কিন্তু তাকে স্লো বল করে বিপাকে ফেলে দেয় অস্ট্রেলিয়া। আলো না ছড়িয়েই সাজঘরে ফেরত যান সূর্য। ২৮ বলে ১৮ রান করে হ্যাজেলউডের শিকার হন তিনি।
শেষ ওভারে এসে একটি চার হাঁকান মোহাম্মদ সিরাজ। তাতে দলের রানও যায় ২৪০-এর ঘরে। স্টার্ক ১০ ওভারে ৫৫ রান দিয়ে ৩টি উইকেট নেন, দুই উইকেট করে পান হ্যাজলউড আর কামিন্সও।
দ্বিতীয় ইনিংসে বল করতে নেমে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শককে জাগিয়ে তুলেছিল ভারতও। ২৪০ এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে আটকে রাখার আশা জেগেছিল হৃদয়ের আঙিনায়। শেষ অবধি সেসব অবশ্য হয়েছে কেবলই দীর্ঘশ্বাস। পুরো বিশ্বকাপজুড়ে আলো ছড়ানো শামি এদিনও উইকেট পেয়ে যান দ্বিতীয় বলে।
তার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন ওয়ার্নার। কোহলি সেটি এবার ধরতে ভুল করেননি। দ্বিতীয় উইকেটের জন্য ভারতের অপেক্ষা লম্বা ছিল না খুব একটা। এবার বেশ ভালো ছন্দে আছেন, এমন মনে হওয়া মিচেল মার্শ ফিরে যান সাজঘরে।
বুমরাহর বলে পা না নাড়িয়ে ব্যাট চালিয়ে উইটেকরক্ষক রাহুলের হাতে ক্যাচ দেন ১৫ বলে ১৫ রান করা মার্শ। ম্যাচ জমে ওঠার ষোলোকলা পূর্ণ হয় স্টিভেন স্মিথ বুমরাহর বলে এলবিডব্লিউ হলে। পরে অবশ্য টিভি রিপ্লেতে দেখ গেছে, রিভিউ নিলেই বেঁচে যেতেন তিনি।
৪৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলার বাকি গল্পের পুরোটাজুড়ে কেবল ট্রাভিস হেড। তার ক্যাচই গিলের সঙ্গে দ্বিধায় থেকে নিতে যাননি স্লিপে দাঁড়ানো কোহলি। ভারতের কোনো বোলারই পরে পাত্তা পাননি তার কাছে। ইতিহাসের সপ্তম আর অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরির দেখাও পান।
১৫ চার ও ৪ ছক্কায় ১২০ বলে ১৩৭ রানের ইনিংসের পর যখন সাজঘরে ফিরেছেন হেড, এরপর অস্ট্রেলিয়ার জেতার জন্য লেগেছে স্রেফ এক বল। ম্যাক্সওয়েল দৌড়ে দুই রান নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরেছেন। আর মোহাম্মদ সিরাজের চোখের কোনায় জমা হয়েছে জল- পুরো ভারতের কোটি মানুষের মতোই!