ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :আদালতের নির্দেশে চার বছরেরও বেশি সময় আসামিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হতো না। সাম্প্রতিক সময়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাই হয়ে যাওয়ার পর ফের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো শুরু করেছে পুলিশ। এর প্রয়োগ শুরু হতেই একের পর এক অভিযোগ আসছে অপব্যবহারের। সর্বশেষ, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আলী আজম খান হাতে হাতকড়া ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেন। এ ছবি ও সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র চলছে সমালোচনার ঝড়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি আইন ও মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কাণ্ডের নিন্দা করেছেন তারা।
ডাণ্ডাবেড়ি সাধারণত পরানো হয় দুর্ধর্ষ প্রকৃতির আসামি, দাগি অপরাধী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের। রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার আলী আজমের পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন ডাণ্ডাবেড়ির অপব্যবহার ও রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। একজন আসামিকে মায়ের জানাজায় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা মৌলিক মানবাধিকারেরও পরিপন্থী।
শুধু আলী আজমই নয়, কিছুদিন আগে বিএনপির আরেক নেতার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির নন, এমন আসামিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অথচ গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে ডাণ্ডাবেড়ি ছাড়াই কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। এরপর ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর আবার ডা-াবেড়ি পরিয়ে আসামি হাজির শুরু করে কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচারাধীন মামলায় এমন একজন আসামিকে এভাবে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো বেআইনি ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সাধারণত চরম অবস্থা ছাড়া ডাণ্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। কারণ এটি একটি নির্যাতন। এটি অত্যাচার। কোনো সময়েই পরানো উচিত না।
একাধিক জেল সুপার ও জেলার বলছেন, চার বছরের অধিক সময় ডাণ্ডাবেড়ি পরানো বন্ধ ছিল। আর সাধারণত প্যারোলে মুক্তি পাওয়া আসামিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হতো না। তবে জঙ্গি পালানোর পর অধিকতর সতর্কতার অংশ হিসেবে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ বা কারা কর্তৃপক্ষ ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে চায় না। রাজনৈতিক ঘটনায় অধিকাংশ পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও বিস্ফোরক মামলার আসামি। আসামির গায়ে তো লেখা থাকে না তিনি কোন ধরনের ব্যক্তি। কাগজপত্র দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে এই ধরনের মামলার আসামিদের দুর্ধর্ষ ও ভয়ানক হিসেবে বিবেচনা করে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়। মঙ্গলবার গাজীপুরের মতোই সম্প্রতি নাটোরের নলডাঙ্গাতে এক আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
গত মঙ্গলবার মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বিএনপি নেতা আলী আজমকে। তাকে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজাস্থলে হাজির করে পুলিশ। সে সময় ডা-াবেড়ি খুলে দিতে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে অনুরোধ করলেও খোলা হয়নি। ডাণ্ডাবেড়িসহ মায়ের জানাজা পড়েন আলী আজম। হৃদয়-নাড়ানো এ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনা শুরু হয়।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, আলী আজমের পরিবার থেকে প্যারোলের আবেদন করা হলে তা অনুমোদন করা হয়। এ সময় সাম্প্রতিক সময়ের নানা দুর্ঘটনার বিবেচনায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তাসংবলিত নির্দেশনা দিয়ে ব্যবস্থা নিতে জেল সুপারকে বলা হয়।
গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার বজলুর রশিদ বলেন, এখানে কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি। আমরা নিয়ম মেনেই তাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েছি। সম্প্রতি জঙ্গি পালানোর পর থেকে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। জানাজার সময় ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া যেত কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পালিয়ে গেলে এর দায় কিন্তু আমাদের ওপরই পড়ত।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বিষয়টি জানতেন না। ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো জেল প্রশাসনের কাজ। সেটি পুলিশের অধীনে নয়; একজন আইজি প্রিজন্স আছেন, সেই প্রশাসনের অধীনে। কয়েকদিন আগে দুই জঙ্গি পালিয়ে গেছে এবং তাদের প্রতি যেভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার ছিল, সেটি করা হয়নি বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ জন্য তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে। তবে আমি মনে করি, জানাজার সময় ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া খুলে দিলে ভালো হতো।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আসামির কেসটা কী ছিল আমার জানা নেই। সম্প্রতি ডাণ্ডাবেড়ি না থাকার কারণেই ২ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সঙ্গীরা। মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করেই এমন নমনীয়তা দেখানো হয়েছিল। এরপর তিনি যোগ করেন, তবে জানাজার সময় ডাণ্ডাবেড়ি থাকাটা আমি ভালো মনে করি না। সঠিক হয়নি ব্যাপারটা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমরা খোঁজ নেব। মানবাধিকারের লঙ্ঘন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জেলকোড অনুযায়ী, শুধু দুর্ধর্ষ বন্দিদের নিরাপদ আটক নিশ্চিতে আদালতে পাঠানোর সময় পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর কথা বলা হয়েছে। দুর্ধর্ষ বা ঘৃণ্য অপরাধী চিহ্নিত করা আদালতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্ব। তিনি আসামির অতীতের অপরাধের বৃত্তান্ত জেনে দুর্ধর্ষ কিনা তা চিহ্নিত করবেন। এমন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আগে কোর্টের পুলিশ পরিদর্শক লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট জেলারকে জানাবেন। পুলিশের লিখিত চিঠি প্রাপ্তির পর সব ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে কারা কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে বন্দি দুর্ধর্ষ, যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত এবং উগ্র বা ভয়ংকর প্রকৃতির, পালানোর চেষ্টা করতে পারে, তবেই কারারুদ্ধ অবস্থায়ও ডাণ্ডাবেড়ি পরাতে পারবে।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ব্যাপারে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যদি ডাণ্ডাবেড়ির অপব্যবহার না হতো তা হলে সমালোচনা হতো না; বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়াতও না। জানাজার সময় ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে দুই জঙ্গি ছিনতাই হওয়ায় পুলিশ হয়তো কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত। কিন্তু দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলে সবাইকেই যে নিয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। একজন মানুষকে জানাজার নামাজের সময়ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা প্রমাণ করছে তারা খুবই দুর্বল। স্বাভাবিক নিরাপত্তা দিতে পারছে না। অবস্থা এমন দুর্বল হলে রাষ্ট্রকে তারা কীভাবে রক্ষা করবে? বন্দিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা যেত। তারা অনেক যুক্তি দেখাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, এটা সঠিক হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে চারজনকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করার ছবি সংবাদমাধ্যমে এলে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্সকে তলব করেন হাইকোর্ট। পরে আদালতের আদেশে বলা হয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালত কক্ষে কোনো আসামিকে হাজির করা যাবে না। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় ডাণ্ডাবেড়ি পরানো যাবে। এরপর থেকে গত ৪ বছর ধরে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির আসামিকেও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হতো না।
সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, আসামি কোন প্রকৃতির, দুর্ধর্ষ কিনা, তা পুলিশই নির্ধারণ করে দেয়। কারা কর্তৃপক্ষ বন্দির অপরাধ অনুযায়ী জেলখানার ভেতরে ব্যবস্থা নেয়। সাধারণত প্যারোল সেই আসামিদেরই দেওয়া হয় যারা ভদ্র, মার্জিত এবং যাদের ওপর সরকারের আস্থা থাকে। তবে জঙ্গি পালানোর পর সরকারের সুনাম অনেক ক্ষুণ্ণ হওয়ায় পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এর পরও মানবিক দিকটি বিবেচনায় রেখে জানাজার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই তার ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া যেত।
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান বলেন, আমাদের সংবিধানের আলোকে কাউকে কষ্টের মধ্যে রাখা যাবে না। সংবিধান ও মানবাধিকারের আলোকে চিন্তা করলে, এ ধরনের ব্যবস্থা নিপীড়নমূলক এবং আইনের লঙ্ঘন। ৩ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া একজনকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আনা আইনের ব্যত্যয়। যারা এটি করেছেন, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। আলী আজমকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো চরম নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক কাজ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে বিএনপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, গায়েবি মামলায় কারাবন্দি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আলী আজম খান তার মায়ের মৃত্যুর পর প্যারোলে মুক্তি পেয়ে জানাজায় অংশ নিতে গেলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরা অবস্থায় সেখানে হাজির করেন। তিনি ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেন। প্যারোলে মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কারাবন্দির সঙ্গে এহেন আচরণ মানবাধিকার ও কারাবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে গায়েবি মামলার আসামি হয়ে তিনি বন্দি। তার বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী খোদ অস্বীকার করেছেন, তিনি এ মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি দুর্ধর্ষ জঙ্গি বা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত কোনো সন্ত্রাসী বা দাগি আসামি নন। তার সাথে এ ধরনের আচরণ চরম অমানবিক, বেআইনি, সংবিধান পরিপন্থী এমনকি আইন-আদালতের নির্দেশনারও পরিপন্থী।










