ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক :চলতি বছর দফায় দফায় ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জ জেলা। পানিতে ভরপুর ছিল নদ-নদী ও হাওরগুলো। অথচ বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে জেলার বৃহত্তর ‘দেখার হাওরে’ পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধানের খেত শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে। এ হাওরে এবার বোরো আবাদ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক। তারা অভিযোগ করে জানান, নভেম্বরেই জলমহাল ইজারাদাররা তাদের স্বার্থে হাওরের বাঁধ কেটে পানি ছেড়ে দিয়েছেন। এতে করে বোরো চাষের জমি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুধু দেখার হাওর নয়, জেলার অন্যান্য হাওরগুলোর পানিও দ্রুত নেমেছে। এতে বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে হাওরের কৃষকের মাঝে। তাই বোরো ধানের খেত বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলার কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার ১২ উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি অনাবাদি। দ্রুত সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দেখার হাওরের কৃষক জানান, সুনামগঞ্জ জেলা সদর, শান্তিগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত দেখার হাওর। অন্যান্য বছর এ সময়ে হাওরগুলোয় পানিতে টইটম্বুর থাকে। জমিতে এ সময় হাঁটুপানি থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে পুরো দেখার হাওরের বোরো আবাদের জমি শুকিয়ে ফাটল ধরেছে। এর মূল কারণ দেখার হাওরের জলমহাল বড়দই বিল, কাস্টগঙ্গা বিলসহ কয়েকটি জলমহালের ইজারাদাররা বিলগুলোয় বেশি মাছ ও লাভের আশায় নভেম্বর থেকে বাঁধগুলো কেটে দিয়ে পানি ছেড়ে দেন। এতে করে হাওরের পানি ধীরে ধীরে নেমে শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে পানি সংকটে জমিতে চাষাবাদ হবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় হাওরের কৃষক।
সরেজমিনে গতকাল সকালে দেখা যায়, সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের লালপুর এলাকায় দেখার হাওরের বোরো জমিতে আইলে কাজ করছেন রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষক মোশাহিদ। এবার তিনি ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষের প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু পানি সংকটে তার স্বপ্ন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। পানির অভাবে তার জমি ফেটে চৌচির। এছাড়া মোল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমানসহ অর্ধশতাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এবার বোরো ধান চাষাবাদ হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। হাওরের একটি চক্র তাদের নিজেদের স্বার্থে বাঁধ কেটে পানি ছেড়ে দিয়েছে। এতে করে হাওরের পানি নেমে যাওয়ায় সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন হাওরের কৃষক।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভাগ বলছে, হাওরঅধ্যুষিত জেলার ১২ উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি রয়েছে। এর মধ্যে এবার বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর বোরো ধান আবাদ হয়। গতবারের চেয়ে এবার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ কম হবে। বোরো ধানের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে আমরা এবার সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমি রবি শস্যের আওতায় নিয়ে আসব। কৃষককে প্রণোদনার মাধ্যমে বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ, সরিষা, শাক-সবজিসহ নানা জাতের বীজ দিচ্ছি। এছাড়া আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পানির সেচের মেশিন পাব। সেগুলো দিয়ে এসব জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
দেখার হাওরের কৃষক সাদিকুর রহমান জানান, দেখার হাওরে তার ২০ বিঘা জমি আছে। একফসলা জমির ওপর পুরো সংসার নির্ভরশীল, কিন্তু এবার দেখার হাওরের জলমহাল ইজারাদাররা বাঁধ কেটে পানি ছেড়ে দিয়েছেন। এতে হাওরের বোরো জমির পানি পুরোটাই নেমে শুকিয়ে গিয়েছে।
ওই হাওরের কৃষক বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির উদ্দিন জানান, বোরো ধানের চারা রোপণের আগেই হাওরের জমি শুকিয়ে ফাটল ধরেছে। জলমহালের মালিকরা তাদের স্বার্থে বোরো চাষাবাদের আগেই হাওরের পানি ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। এতে কৃষকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। পানির অভাবে এবার বোরো চাষাবাদ নাও হতে পারে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাব দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার। কৃষককে বাঁচাতে দ্রুত পানির ব্যবস্থা করে দেয়ার।
আরেক কৃষক ফেদাউর রহমান বলেন, গত বছর বন্যায় বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। এবার বোরো ধান লাগানোর আগেই পানি সংকট দেখা দিয়েছে। হাওরবাসীর কাছে এটি এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেখার হাওরের বোরো ধান উঠলে দেশের মানুষের ১৫ দিনের খাবার হয়, কিন্তু পানি সংকটে বোরো ধান আবাদ না হলে দেখার হাওরসহ জেলাবাসীর খাবার সংকট দেখা দিতে পারে। তাই কৃষক বাঁচাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, জেলার ১২ উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি অনাবাদি রয়েছে। এবার বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। আমরা বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রবি শস্যের দিকে গুরুত্ব দিয়েছি। এরই মধ্যে আমি জেলার সব উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি বোরো চাষাবাদে পানির সংকট কোন কোন জায়গায় আছে সেগুলো চিহ্নিত করতে। আর দেখার হাওরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পরিদর্শনে যাবেন। পরিদর্শন শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা চাই জেলার কোনো জায়গা যেন অনাবাদি না থাকে।
দেখার হাওরের আয়তন ৮ হাজার ৯১০ হেক্টর। সম্পূর্ণ জমিতে ধান চাষ হয়। এর মধ্যে পুরো হাওর শুকিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ করেন কৃষক।
দেখার হাওরের জলমহাল ইজারাদার মানোয়ার হোসেনের সেলফোনে কল দিলে এক ব্যক্তি ফোন রিসিভ করেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মনোয়ার হোসেন ঘুমে আছেন বলেই ফোন কেটে দেন। এরপর আর বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করলে ফোন রিসিভ করেনি কেউ।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, দেখার হাওরে পানি সংকট দেখা দিয়েছে বলে কৃষকের অভিযোগটি শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।










