ইউকে শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
হেডলাইন

লন্ডনে সাবিনা’র হ’ত্যাকা’ণ্ডকে ঘিরে ক্ষোভ ও বিতর্কের ঝড় বইছে

লন্ডনে সাবিনা’র হ’ত্যাকা’ণ্ডকে ঘিরে ক্ষোভ ও বিতর্কের ঝড় বইছে

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : লন্ডনে কয়েক দিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি হ’ত্যাকা’ন্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাবিনা নেসা হ’ত্যাকা’ন্ডটি। যা শুধু লন্ডনই নয়, বরং সারা বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ও ঘৃ’ণা আর আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে লন্ডনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে।

গত শনিবার বিকেলে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের এক পার্কের ভেতর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এক নারীর মৃ’তদেহ। পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি লা’শটি দেখতে পান। সাথে সাথে বিষয়টি পু’লিশকে জানানো হয়। তখনো কেউ জানে না, এই নারীর নাম, কী’ তার পরিচয়।

সোমবার হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে ছাপা হলো খবরটি। সাথে পু’লিশের কাছ থেকে পাওয়া একটি ছবি। কালো গ্রাজুয়েশন গাউন পরে ক্যামেরার দিকে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা এই মেয়েটির নাম সাবিনা নেসা।

পু’লিশের ত’দন্তে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কোন এক সময়ে সাবিনা নেসাকে হ’ত্যা করা হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের এক পার্কের ভেততের কোন এক নির্জন স্থানে। এরপর হ’ত্যাকারী তার লা’শটি ফেলে রেখেছিল পার্কে ঝোপঝাড়-ঘাসের আড়ালে। পরদিন বিকেলে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তির নজরে আসার আগে পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল লা’শটি।

এই হ’ত্যাকা’ণ্ডে কেন্দ্র করে শুধু মিডিয়া পাড়ায়ই নয়, রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তাহীনতা- এসব নিয়ে ব্রিটেনে এখন চলছে তুমুল বিতর্ক। ব্রিটেনে কোন শ্বেতাঙ্গ নারী যখন একই ধরণের ঘটনার শিকার হন, তখন ব্রিটিশ মিডিয়ায় সাথে সাথে সেটি নিয়ে যেভাবে ফলাও করে খবর প্রচার হয়, সাবিনা নেসা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় সেটি দেখা যায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

গত কয়েকদিন ধরে অবশ্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে সাবিনা নেসার হ’ত্যাকা’ণ্ড। তবে এই ঘটনার কভা’রেজ নিয়ে বিতর্ক এবং নারীর নিরাপত্তা-হীনতা নিয়ে ক্ষোভ এখনো থামেনি।

কে এই সাবিনা নেসা?

দক্ষিণ লন্ডনের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সাবিনা নেসা। ২৮ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পড়াশোনা করেছেন গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা নেসাকে একজন “মেধাবী, দয়ালু এবং নিবেদিতপ্রা’ণ” শিক্ষক বলে বর্ণনা করেছেন।

সাবিনা নেসার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জে’লার জগন্নাথপুর উপজে’লায়। যু’ক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের একটি ছোট্ট শহরে স্যান্ডিতে থাকেন তার পরিবার। বাবা আবদুর রউফ কাজ করেন স্যান্ডির একটি রেস্টুরেন্টে।

পু’লিশ এবং ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাবিনা নেসা শুক্রবার সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে খুব কাছেই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পু’লিশের ধারণা বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই হয়তো তাকে হ’ত্যা করা হয়েছে।

হ’ত্যাকারী কে?

এই হ’ত্যাকা’ণ্ডের র’হস্য এখনো অনুদঘাটিত, হ’ত্যাকারী এখনো ধ’রা পড়েনি। পু’লিশ এপর্যন্ত কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ। একজন স’ন্দেহভাজনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।

পু’লিশের ত’দন্ত যেভাবে আগাচ্ছে এবং যেসব তথ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে কোন অ’পরিচিত ব্যক্তির হাতেই হয়তো খু’ন হয়েছেন সাবিনা নেসা।

লন্ডনের মেট্রোপলিটন পু’লিশ একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে, যাতে একজন টাক মা’থার পুরুষকে হাতে কিছু একটা নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। পু’লিশ মনে করছে সাবিনা নেসা হ’ত্যা র’হস্য উদঘাটনে এই ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভিডিও ফুটেজের এই লোকটির পরণে ধূসর রঙের জিন্স এবং কালো জ্যাকেট। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে মা’থায় হুড টেনে দিতে দেখা যায়।

মিডিয়া কভা’রেজ নিয়ে বিতর্ক

সাবিনা নেসা হ’ত্যাকা’ণ্ডের খবর ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরুতে অ’তটা গুরুত্ব পায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক্ষেত্রে তার হ’ত্যাকা’ণ্ডের খবরকে তুলনা করা হচ্ছে কয়েক মাস আগে লন্ডনে একই ধরণের ঘটনার শিকার হওয়া এক শ্বেতাঙ্গ নারী সারা এভা’রার্ডের হ’ত্যাকা’ণ্ডের সঙ্গে।

সারা এভা’রার্ড নি’হত হন এ বছরের মা’র্চে দক্ষিণ লন্ডনে। তিনিও সেদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন রাতে, পথে তাকে অ’পহ’রণ করে এক পু’লিশ, পরে তার লা’শ পাওয়া যায় একটি পার্কে।

তার হ’ত্যাকা’ণ্ড ব্রিটেনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, দিনের পর দিন এই হ’ত্যাকা’ণ্ডের খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে রেখেছিল। এই হ’ত্যাকা’ণ্ডের প্রতিবাদে এবং ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে যে বড় বড় বি’ক্ষোভ হয়, তাতে এমনটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটনও যোগ দিয়েছিলেন।

কিন্তু সাবিনা নেসার হ’ত্যাকা’ণ্ডের পর অন্তত প্রথম কয়েকদিন সেধরণের কভা’রেজ দেখা যায়নি বলে অনেকে অ’ভিযোগ করছেন।

লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একজন কাউন্সিলর রাবিনা খান বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক পোস্ট তিনি দেখেছেন, যেখানে অনেকে প্রশ্ন করছেন, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী বা সংখ্যালঘু নারী যদি সারা এভা’রার্ডের মতো নি’খোঁজ হয়ে যান, তিনি কি আসলে মিডিয়ায় একই ধরণের মনোযোগ পাবেন?

নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

সাবিনা নেসার হ’ত্যাকা’ণ্ড একই সঙ্গে নতুন করে ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে।

দক্ষিণ লন্ডনের যে জায়গায় সাবিনা নেসার দেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছেই শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন শত শত মানুষ। সেখানে তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবিনার প্রতি শ্রদ্ধা জানান, এই হ’ত্যাকা’ণ্ডের বিচার এবং নারীর বি’রুদ্ধে সহিং’সতার অবসান দাবি করেন।

সাবিনা নেসার বোন জেবিনা ইয়াসমিন ইস’লাম সেখানে কথা বলতে গিয়ে কা’ন্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

তিনি বলেন, “আমাদের অনুভূতি এখন কী’, তা কোন শব্দ দিয়ে আম’রা প্রকাশ করতে পারবো না। মনে হচ্ছে আম’রা একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে আ’ট’কে আছি। কোন পরিবারকে যেন এরকম ঘটনার শিকার হতে না হয়।”

লন্ডনের মতো একটি শহরেও ঘরের বাইরে নারীদের কী’ভাবে সারাক্ষণ নিরাপত্তা-হীনতায় ভুগতে হয়, তার উদাহ’রণ দিচ্ছিলেন রেডব্রিজ কাউন্সিলের একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর সৈয়দা সায়মা আহমেদ ।

রেডব্রিজ কাউন্সিলের ‘উইমেনস চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে তিনি ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন। এই কাজের অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে তারা ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে একটা জ’রিপ মতো চালিয়েছিলেন।

সৈয়দা সায়মা আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সেখানে নারীরা আমাদের জানিয়েছেন, রাতে হোক বা দিনে হোক, তারা যখন ঘরের বাইরে যান, তারা ধরেই নেন যে ঘরের বাইরে গেলে তাদেরকে কটূক্তি শুনতে হবে, পুরুষের হাতে শারীরিকভাবে লা’ঞ্ছিত হতে হবে। রাস্তায় হয়তো তাদেরকে কেউ অনুসরণ করতে পারে। নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে ব্যাগের মধ্যে কিছু না কিছু নিয়ে বের হতে হয়। অনেকে জুতো বদলান কাজ থেকে ফেরার সময়, যা পরে দৌড় দেয়া যায়। অন্ধকার গলির দিকে তারা যান না, তারা ভয় পান। তাদেরকে হয়তো কেউ নি’পীড়ন করতে পারে। এগুলো এতটাই স্বাভাবিক যে, সবাই জানে।”

সাবিনা নেসার হ’ত্যাকা’ণ্ডের পর ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ঘরের বাইরে নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টা করা হতে পারে, এমন আশংকা করেন কেউ কেউ।

কিন্তু সৈয়দা সায়মা আহমেদ বলছেন, এটি কোন সমাধান নয়।

“আমাদেরকে ভাবতে হবে, মেয়েদেরকে আ’ট’কে রেখে নয়, বরং যারা নারীকে আক্রমণ করছে, যারা নি’পীড়নকারী, তাদেরকে কী’ভাবে শিক্ষা দেয়া যায়, সেটাই বরং ভাবতে হবে। এখানে দরকার নারীর ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।”

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com