ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : ‘জোর করে কখনো কবিতা লিখনি, আজো না। কবিতা আমি তখনই লিখি যখন কবিতা নিজে এসে আমার ওষ্ঠ চুম্বন করে’। এমন সহজ-সরল, সাধারণ উক্তিকারী হলেন বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। শুধু যদি কবি বলি, তবে ভুল হবে। আবদুল মান্নান সৈয়দ শুধু কবিই ছিলেন না, সাহিত্যের সব শাখায়ই ছিল তার সরব, সফল বিচরণ। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, শিল্পী, সম্পাদক এবং ছিলেন একজন সুনিপুণ সমালোচক। সাহিত্যের যে শাখায়ই তিনি বিচরণ করেছেন, সে শাখাই তাঁর পদধূলিতে ধন্য হয়েছে, যে শাখাই তাঁর হস্তস্পর্শ পেয়েছে, সে শাখাই হয়ে উঠেছে পরিপুষ্ট। যে বাগানেই তিনি প্রবেশ করেছেন, সে বাগান আর পুষ্পিত, সুরভিত না হয়ে থাকতে পারেনি। সাহিত্যের সব শাখায় যেমন সফল বিচরণ তিনি করেছেন, তেমনি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, গদ্যছন্দ, মিশ্রছন্দসহ বাংলা কবিতার পূর্বাপর সব ছন্দেও তাঁর হস্ত ছিল সিদ্ধ ও পাকাপোক্ত।
১৯৪৩ সালে জন্ম নেওয়া বাংলা সাহিত্যের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাহিত্য-সাধনার সময়কাল ছিল মূলত ষাট-পরবর্তী। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ — এদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন : ‘মাইকেল বেঁচেছিলেন ঊনপঞ্চাশ বছর, তার মধ্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেছেন মাত্র পনের বছর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাশি বছরের আয়ুষ্কালের পঁয়ষট্টি বছর। নজরুল তাঁর তেতাল্লিশ বছরের সুস্থাবস্থায় তেইশ বছর, জীবনানন্দ তাঁর পঞ্চান্ন বছরের জীবনকালে চল্লিশ বছর কবিতা চর্চা করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান চারজন কবির তিনজনই অকালমৃত বা জীবন্মৃত। কিন্তু তাতে কোনো যায়-আসে না। কবিতার জন্য যৌবনই শ্রেষ্ঠ সময়। তাই, মাইকেল, নজরুল ও জীবনানন্দ তাঁদের স্বল্প সময়ের জীবন-সফরেই কবিতার বিশ্ব দর্শন করেছিলেন। কিন্তু, যে হিসাব এখানে উপস্থিত করলাম, তা কেবল তাঁদের প্রকাশ্য সাহিত্যচর্চার দিক থেকে। আসলে এই চারজনই তাঁদের চৈতন্যের সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন কবিতায় এবং তা আবাল্য ও আমৃত্যু। (ছন্দ – ৫৯)
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতির সূত্র ধরে আমরাও বলতে চাই এবং বলতে পারি— আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রকাশ্য সাহিত্যচর্চাকাল যদিও ১৯৬৫ পরবর্তী, কিন্তু আসলে তিনি তাঁর চৈতন্যের সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন কবিতায় এবং একধাপ এগিয়ে বলা চলে সমালোচনায়ও। এবং তা-ও আবাল্য ও আমৃত্যু। তাঁর প্রকাশ যদিও ৬৫ এর পর, কিন্তু বিকাশ এর আরও আগে থেকেই।
তাঁর নিজের জবানীতেই শুনি, তিনি বলেছেন : ‘আমার জীবনে লেটো পিরিয়ড আছে নজরুলের মতো। পিরিয়ডটা হলো আমার ক্লাস সেভেন-এইট থেকে এম এ পাশ পর্যন্ত। আমি বিরামহীন লেখালেখি করতাম আর ছবি আঁকতাম। কিন্তু আব্বা আমার লেখা প্রকাশিত হতে দিতেন না। ওই পিরিয়ডে আমি নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত ও সংস্কৃত করার চেষ্টা করেছি। আমার কঠোর আব্বা কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন, চাচাও মেধাবী ছাত্র। আমাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন, যেন আমি এম এ পাস করি। এজন্য ১৯৬৫ সালকে আমি ধরি আমার আত্মপ্রকাশের বছর’।
তবে প্রকাশের পর তাঁর বাবা তাঁর জন্য বাড়িতে একটা আলাদা ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার জন্য। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সময়কার কবিদের অস্বীকার করে নয়, বরং নিজের সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তাঁদেরকে অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যে উন্মোচন করেছিলেন ‘পরাবাস্তবতা’র নতুন দিগন্ত। বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁর সময়কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সফল, পূর্ণাঙ্গ পরাবাস্তববাদী কবি তিনিই। এর আগের কবিদের কবিতায় পরাবাস্তবতার উঁকিঝুঁকি পরিলক্ষিত হলেও আবদুল মান্নান সৈয়দ-এ এসে তা পূর্ণতা লাভ করেছে। অন্যদিকে সাহিত্য-সমালোচনায়ও এপর্যন্ত তাঁর জুড়ি মেলা ভার। শুধু বাংলাদেশই নয়, উভয় বাংলার হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন অতুলনীয় সাহিত্য-সমালোচক।
এই ছন্দের কারুকাজ আর সমালোচনাই মূলত তাঁকে বাংলা সাহিত্যের শীর্ষ আসনে স্থান করে দিয়েছে। সাহিত্য-সমালোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তিনি তাঁর উপস্থাপনের সহজতা বর্ণনার সাবলীলতা দ্বারা সাহিত্যের সাধারণ পাঠকদের জন্যও সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। ছন্দের বিশ্লেষণ তিনি এমনভাবে করেছেন যে, তা শুধু পরিণত কবিদেরই পাঠ-উপযোগী থাকে নি, বরং কবিযশোপ্রার্থীদের জন্যও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের সর্বশাখায় বিচরণ করে তিনি নিজের উপস্থিতিকে এমনভাবে জানান দিয়েছেন যে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থা ও অবস্থানকে অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ আর বাকি থাকে নি।
কিন্তু যেহেতু কর্তার কীর্তির স্বীকৃতি তাঁর জীবদ্দশায় প্রদান করা আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী, তাই ফররূখের ধারাবাহিকতায় তাঁকেও অবজ্ঞা-উপেক্ষা করা হয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে। এর ফলে সাহিত্যের অনেক পাঠককে তাঁর সম্পর্কে অনবগত দেখা যায়। অনেকে জীবদ্দশায় তাঁর নাম শুনলে ভ্রু কুঁচকাতেন, অথচ মৃত্যুর পর দেখা গেল, তারা কবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা তাঁকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, যেন তিনি ছিলেন তাদেরই একজন। কিন্তু বাস্তব ত এই যে, জীবিত অবস্থায় যারা তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল, মৃত্যুর পরও তারাই উপযুক্ত উত্তরসূরির দাবীদার হওয়ার।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্ম ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের জালালপুর গ্রামে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর পারিবারিক নাম। সাহিত্যে মান্নান সৈয়দ হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। অনেক সময় তিনি ‘অশোক সৈয়দ’ ছদ্মনামেও লিখেছেন। ১৯৫০ এ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তাঁর পিতা সৈয়দ এম এ বদরুদ্দোজা সপরিবারে নৌকায় করে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন এবং ঢাকার গোপীবাগে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে গ্রিন রোডে জমি কিনে সেখানেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। কবির আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরে এবং তিনিও (উর্দু) কবিতা লিখতেন। মা কাজী আনোয়ারা মজিদও ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কবি ঢাকা নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে কলা বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক সম্মান এবং ৬৪ তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
আমাদের সৌভাগ্য যে, সিলেট এমসি কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়েই তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। এছাড়াও তিনি ফরিদপুরের শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজে এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সোনার হরিণ’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘কথা সাহিত্য প্রাসঙ্গিক ‘। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাম্প্রতিক’ পত্রিকায়। এর প্রকাশকাল ১৯৬৩। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’। এছাড়াও প্রকাশিত তাঁ গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, পরাবাস্তব কবিতা, নির্বাচিত কবিতা, আমার সনেট, সত্যের মতো বদমাস, বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, করতলে মহাদেশ, ছন্দ, অ-তে অজগর ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গিয়েও কবি তাঁর জীবনের শেষ বেলায় আফসোস করে বলেছেন : বাংলা সাহিত্যে আমার আরও কাজ করা প্রয়োজন ছিল। আসলেই, যদি কবি বেঁচে থাকতেন আরও কিছু দিন, তাহলে আমরা জানতে পারতাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য, অনেক বিলুপ্ত সত্য। কিন্তু মৃত্যু ও তার সময় যে নির্ধারিত সবার বেলায়, নিজ সময়মতোই তাই সবাই চলে যায়। তাই তো কবিকেও চলে যেতে হয়েছে আমাদের ছেড়ে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর রমজান মাসে ইফতারের পূর্বক্ষণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কবি নিজ বাসভবনে ইনতিকাল করেন। আল্লাহ তাঁর পরকালকে ইহকাল থেকে সুন্দর করুন।
- রেজাউল হক, শিক্ষক, জামিআ সিদ্দিকিয়া বালুচর সিলেট।