ইউকে বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
হেডলাইন

মামুনুলকে নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন বিএনপির মাওলানা শামীম

মামুনুলকে নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন বিএনপির মাওলানা শামীম

 

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর নগ্ন করে নির্যাতন করা হচ্ছে দাবি করে যুক্তরাজ্য থেকে ফেসবুক ও ইউটিউবে লন্ডনপ্রবাসী বিএনপি নেতা মাওলানা শামীম আহমেদ গুজব রটাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি বিএনপির বরগুনা কমিটিতেও আছেন। যুক্তরাজ্য ওলামা দলের সভাপতি পদবিধারী এই ব্যক্তি ওই ভিডিওগুলোতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন ও তসবি টয়লেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন। এমনকি থানায় মারধরের এক পর্যায়ে হেফাজত নেতা রোজার মধ্যেই পানি খেতে চান বলে দাবি তার।

গত ১৯ এপ্রিল জুনায়েদ আহমেদ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে সোমবার ১১.৫৫ মিনিটে ৩২ মিনিট ৫১ সেকেন্ড লাইভ করেন মাওলানা শামীম। মামুনুলকে থানায় বেদম মারধরের অভিযোগ করে শামীম দাবি করেন, সেখানে মোট পাঁচ জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। এদের মধ্যে চার জন মামুনুলকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করছে। আর তাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন অপর একজন। এই ঘটনার প্রতিবাদে তিনি ঈদের পর চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সময় শামীম অভিযোগ করেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পবিত্র কোরআন টয়লেটে ফেলে দিয়েছে।

এছাড়া ধর্মীয় উসকানিমূলক আরো বিভিন্ন মন্তব্য করেন তিনি যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে পারে যে কোনো সময়। তবে এসব মন্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে বা উল্লেখ করতে পারেননি তিনি। তথ্যগুলোর কোনো সোর্সও জানান তিনি।

আদালতে পুলিশের রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করা মামুনুলের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, মামুনুল হক তাদের কাছে নির্যাতনের কোনো অভিযোগ করেনি। তাই তারা আদালতেও এ নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।

হেফাজত নেতার আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের কাছে এ রকম (নির্যাতন) কোনো অভিযোগ নাই! আর এ বিষয়ে আমরা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করি নাই। যদি নির্যাতন বিষয়ে তথ্য প্রমাণসহ কিছু পাই, সে বিষয়ে তখন দেখা যাবে।’

শামীমের লাইভটি হেফাজত ও বিএনপি সমর্থিত বিভিন্ন পেজে শেয়ার দেওয়া রয়েছে। একইসাথে ইউটিউবের bd sk media নামের একটি চ্যানেলেও এটি লাইভ প্রচার হয়। এর আগে ১৮ এপ্রিল তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে লাইভে সরকার পতনের হুমকি দেন। এছাড়া ২৮ মার্চ মাওলানা শামীমের প্রোফাইল থেকে আপলোড করা একটি ভিডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করতেও দেখা গেছে। ভিডিওতে ‘শেখ মুজিবের বাপের নাম’ হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ হাসিনার বাপের নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ এ রকম স্লোগান দিতে দেখা যায়। এর বাইরেও তিনি একাধিকবার লাইভে সরকার, আওয়ামী লীগ, ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিরুদ্ধে নানা রকম উসকানিমূলক কথাবার্তা ছড়িয়েছেন।

ফেসবুকে মাওলানা শামীম সম্পর্কে ঘেঁটে দেখা যায়, Mowlana Shamim নামে তিনি একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছেন। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২ হাজার ৬শ ২৪ জন তার বন্ধু তালিকায় যুক্ত আছেন। বায়োতে তিনি তার দলীয় পরিচয় দিয়েছেন, যাতে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দল যুগ্ম আহ্বায়ক কেন্দ্রীয় কমিটি’, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বরগুনা জেলা বিএনপি। তিনি শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্য দিয়েছেন, সরকারি মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। তার ব্যক্তিগত তথ্যে জন্ম সাল উন্মুক্ত করা না থাকলেও তারিখ দেওয়া আছে ফেব্রুয়ারি ৩।

মাওলানা শামীম বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের হাড়িটানা গ্রামের আবদুল জব্বার মুন্সির ছেলে। তিনি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা এলাকার একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। পরে ঢাকার গেন্ডারিয়া নেছারিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেন। আবদুল জব্বার মুন্সির তিন ছেলের মধ্যে শামীম ২য়, বড় ভাই শাহ আলম শাহীন যুক্তরাজ্যে থাকেন, ছোটভাই শাহ জালাল সাইমুন এলাকায় ইট বালু সিমেন্ট ব্যবসা করেন। ২০১০ সালের শুরুর দিকে পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নে বিয়ে করেন শামীম। ওই বছরই ব্যবসা পরিচালনার জন্য শামীমকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান তার বড় ভাই শাহীন। কিন্তু, শামীমের উগ্র চলাফেরা, আপত্তিকর আচরণের জন্য দু’বছরের মধ্যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটে। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে চলে যান শামীম। দীর্ঘ ১১ বছরেও তিনি এলাকায় ফেরেননি। শামীমের স্ত্রী ১০ বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান নিয়ে চরদুয়ানী এলাকায় তার বাবার বাড়িতে থাকেন।

বিদেশে অবস্থান করলেও ২০১৭ সালে বরগুনা জেলা বিএনপির কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয় শামীমকে। তিনি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ওলামা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। মাওলানা শামীম বর্তমানে লন্ডন অবস্থান করছেন। তিনি সেখানেও যুক্তরাজ্য ওলামা দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবিও ফেসবুকে দেখা যায়।

শামীম বিএনপি করলেও তার বাবা জব্বার মুন্সি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন ব্যক্তি হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। ১৯৬৩ সালে বরিশাল বিএম কলেজে অধ্যয়নরত থাকাকালীন তিনি তৎকালীন ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি (ভিপি) আমীর হোসেন আমুর একজন অনুসারী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে তিনি পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের রিলিফ কমিটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে তিনি উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালে হজব্রত পালনে যাওয়ার আগে দলীয় সব পদ পদবি থেকে অব্যাহতি নেন। জব্বার মুন্সি বর্তমানে পাথরঘাটা পৌর শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করেন।

ছেলে মাওলানা শামীমের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে বাবা আবদুল জব্বার মুন্সি আক্ষেপের সুরে বলেন, গোবরে পদ্মফুল হয়, আর আমার হয়েছে পদ্মফুলে গোবর।

মামুনুলকে নিয়ে  সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া লাইভ ভিডিও সম্পর্কে জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দেখিনি, তবে শুনেছি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের রিমান্ড নিয়ে নগ্ন করে নির্যাতন ও কোরআন বাথরুমে ফেলে দেয়া হয়েছে- এ রকম কথাবার্তা বলেছে। সে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী আপত্তিকর নানা ধরনের কথা বলেছে, যা আমি লোকমুখে শুনেছি। শামীমের কর্মকাণ্ডে আমি বাবা হিসেবে লজ্জিত, আমার পরিবার বিব্রত।

মাওলানা শামীমের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরটি তার বাবা জব্বার মুন্সি দিতে পারেননি।

মাওলানা শামীমের বিষয়ে কথা হয় জেলা বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি মাওলানা শামীমকে বরগুনা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক লাইভে স্ট্যাটাসে বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছে শামীম, যা আমরা শুনেছি। গ্রেপ্তার হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে সম্প্রতি শামীমের ফেসবুক লাইভটি আমি দেখিনি। যেহেতু সে প্রবাসে, তার ব্যাপারে আমার কোনও মন্তব্য নেই।

এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপেজলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাবির হোসেন বলেন, মাওলানা শামীমকে শিক্ষাজীবনে ছারছিনার একজন অনুসারী হিসেবে চিনতাম। তার বাবা আবদুল জব্বার মুন্সি দীর্ঘবছর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর পর আমি জানতে পারি সেই শামীম বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছে। সেখানে থেকে শামীম প্রায়ই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে লাইভ বক্তব্য দিয়ে আসছে। সম্প্রতি মামুনুল হক ইস্যুতে সে বেশ কয়েকবার লাইভে সরকারবিরোধী উসকানিমূলক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে গুজব ছড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছে। লন্ডনে থাকায় আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারিনি।

শামীমের এসব কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান এই আওয়ামী লীগ নেতা।

মাওলানা শামীমের বিষয়ে তার উপজেলা বরগুনার পাথরঘাটা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবুদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিদেশে আছেন তাই তার বিষয়ে কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ