ইউকে শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

মুশতাকের মৃত্যুতে উদ্বেগ, কিশোরকে নিয়ে শঙ্কা

মুশতাকের মৃত্যুতে উদ্বেগ, কিশোরকে নিয়ে শঙ্কা

 

ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশের লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এদিকে মুশতাকের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট কিশোরের শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় তার পরিবার।

লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এদিকে মুশতাকের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট কিশোরের শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় তার পরিবার।

বৃহস্পতিবার রাতে কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর খবর বের হওয়ার পর থেকেই ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও উদ্বেগ জানিয়েছে। আহবান জানানো হয়েছে স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের। পাশাপাশি কার্টুনিস্ট কিশোরের মুক্তির আহবানও জানিয়েছে দুইটি আন্তর্জাতিক সংগঠন।

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি উঠলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন আইনটি অপরিহার্য। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন গড়ে তুলেছি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। কেউ যেন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে না জড়াতে পারে, সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা অপরিহার্য। সমালোচনা যারা করছে, তারা সবকিছু কি অনুধাবন করছে? আজকের এই দিনে আমি অন্য কিছু বলতে চাই না। শুধু এটুকুই বলবো, কারও মৃত্যুই কাম্য নয়। তবে সেটাকে উদ্দেশ্য করে অশান্তিও কাম্য নয়। অসুস্থ হয়ে মারা গেলে কী করার আছে?’

দ্রুত, স্বচ্ছ, স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার আহবান ওইসিডির

এদিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ ঘটনার স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার। শুক্রবার অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) ভুক্ত ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের এক যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, মুশতাক আহমেদ ২০২০ সালের ৫ মে থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারায় বিচারপূর্ব আটক অবস্থায় ছিলেন।

‘আমরা জেনেছি যে, তাকে বেশ কয়েকবার জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। আটকাধীন অবস্থায় তার প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।’ বিবৃতিতে মুশতাকের পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারকে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর একটি দ্রুত, স্বচ্ছ, স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে আহ্বান জানাচ্ছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাসমূহ ও এর প্রয়োগে আমাদের সরকারগুলোর যে উদ্বেগ আছে এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানের প্রতি বাধ্যবাধকতার সঙ্গে এই আইনের সামঞ্জস্য সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অব্যাহতভাবে আলোচনা চালিয়ে যাব।’

তবে এই বিবৃতির বিষয়ে সরকারের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগ জানায় সংস্থাটি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের মে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে র্যা ব। কমিশন মনে করে, অনাকাঙ্খিত যে কোনো মৃত্যু সংবিধান ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।

কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র বা তার অধীনস্থ কোনো সংস্থা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন করে কমিশনকে অবহিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।

মুশতাক ১০ মাস ধরে বন্দি, ছয়বার আবেদন করেও জামিন পাননি। কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘জামিন অযোগ্য ধারায় কাউকে গ্রেফতার করা হলেও বিচারক চাইলে তাকে জামিন দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুশতাককে কেন জামিন দেওয়া হয়নি, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। এভাবে কারাগারে একজনের মৃত্যু অবশ্যই মানবাধিকারের লংঘন। নিরপেক্ষ একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে এটির অনুসন্ধান করা সরকারের দায়িত্ব।’

দুটি তদন্ত কমিটি গঠন

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে এ পর্যন্ত দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদারকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম, কারা উপ-মহাপরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির, গাজীপুর জেলা কারাগারের সহকারী সার্জন ডা. কামরুন নাহার। এছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপ-সচিব আরিফ আহমদ কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে কারা কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার গাফিলতি ছিল কি-না, যদি থাকে তবে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এই কারাগারে আসার পর তার কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন কি-না, যদি থাকেন তবে সে বিষয়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি-না, যদি না হয়ে থাকে তাহলে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই কমিটিকে।

এছাড়া কারা কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন। তিনি বলেন, একজন ডিআইজি প্রিজন্সকে প্রধান করে তিন সদস্যের গঠিত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর বিচার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি ও আইনটি বাতিলের দাবিতে শনিবার দুপুরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে শুক্রবার মশাল মিছিল করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া সাত নেতাকর্মীর মুক্তির দাবিও জানান তারা।

সমাবেশে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সভাপতি আল কাদেরী বলেন, ‘গতকাল আমাদের শান্তিপূর্ণ মশাল মিছিলে পুলিশের হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন আহত হয়েছেন। বিনা উসকানিতে আমাদের সাতজন নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। আমরা অবিলম্বে তাঁদের মুক্তি দাবি করছি। তাঁদের মুক্তি না দেওয়া হলে ছাত্ররা বসে থাকব না। আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব।’

এদিকে শুক্রবারের ঘটনায় শাহবাগ থানা পুলিশের মামলায় আরও ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের শনিবার আদালতে হাজির করা হলে সাতজনকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

মুশতাকের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া আহমেদ কবির কিশোরের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কিশোরের ভাই আহসান কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যখন আদালতে হাজির করে তখন আমরা সেখানে দেখা করেছিলাম। তখন কিশোর আমাদের জানিয়েছে, অত্যচারের কারণে তার বাম পায়ের গোড়ালিতে ইনফেকশন হয়ে গেছে। যে কারণে হেঁটে বেশিদূর যেতে পারে না। কারও সাহায্য নিতে হয়। নির্যাতনে তার কানের পর্দা ফেটে গেছে। চিকিৎসা না হওয়ার কারণে সেখান দিয়ে পুজ বের হয়। আর তার ডায়াবেটিস এখন ১৮ থেকে ২৭ এর মধ্যে উঠানামা করে। এই কারণে সে চোখেও খুব একটা ভালো দেখতে পারে না।’ তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে নির্যাতন করেছে। কারাগারে চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে কবির বলেন, ‘মাঝে মধ্যে তাকে কারা হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু সেখানে তো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই।।’

কিশোরের ভাইয়ের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘চিকিৎসায় তো অবহেলা করার সুযোগ নেই। বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হলেও সে ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্যই আমি বিষয়টি দেখব।’

কিশোরের মামলা তুলে নিয়ে তাকে মুক্তি দেয়ার আহবান জানিয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন পেন আমেরিকা। জেলখানায় তাকে শারীরিক নির্যাতনের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কমিটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব জার্নালিস্ট-সিপিজে।

এদিকে খুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিনকে আটক করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে তাকে ভাড়া বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের পুলিশ। মুশতাক আহমেদকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রুহুল আমিন। তিনি মুশতাক আহমেদের সঙ্গে গ্রেফতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের খুলনার বাসায় ভাড়া থাকতেন। সেই বাসা থেকেই তাকে আটক করে খুলনা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

একই সঙ্গে আটক করা হয় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সংগঠক নিয়াজ মুর্শিদকে। তবে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বলেন, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ডিবি ও কেএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি দল যৌথভাবে ওই বাসায় অভিযান চালায়। ওই সময় রুহুল আমিনসহ তারা কয়েকজন শ্রমিক রাজনীতি প্রসঙ্গে একটি অনলাইন লাইভ প্রোগ্রামে ছিলেন। সেখান থেকে তাদের তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিয়াজ মুর্শিদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে রুহুল আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে আটক রাখা হয়। ওই সময়ই তারা জানতে পেরেছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে রুহুল আমিনকে গ্রেফতার  দেখানো হতে পারে। সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ