
◻️তাইসির মাহমুদ◻️
আমার এক ভাগনা দুবাই থাকে। বৃটেন করোনা-আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে প্রায়ই সে ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজ-খবর নেয় । ইউকের বর্তমান অবস্থা দেখে সে চরম দুশ্চিন্তায় । যথারীতি সোমবার সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে প্রথমে কুশলাদী জানতে চাইলো। এরপর বললো: “মামা, আপনি দুবাই চলে আসেন। এখানে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চলে যাবেন।”
আমি তার করোনা-মুক্তির প্রস্তাব শুনে ত্রিশ সেকেণ্ড চোখ বুজে থাকলাম । কী জবাব দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বললাম, দুবাই চলে এলে যে করোনা হবেনা- তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবা? সে কিছুটা থতমত খেয়ে বললো- না না, মামা নাহ। এটার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। হায়াত-মউত তো আল্লাহর হাতে। তবে এখানে করোনা-টরোনা নেই।
বললাম, হায়াত-মউত যখন আল্লাহর হাতে তাহলে আপাতত এখানেই থাকি । আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করছি। তুমি আমাদের জন্য দোয়া করো। এই বলে ফোনের ইতি টানতে যাবো- ভাগনা বললো মামা, আরো একটা কথা।
-আচ্ছা, বলো ।
-মামা, আপনাদের লন্ডনের ঘরটি কি ‘বান্দাইয়া’ নিতে পারেন না?
-বললাম, বান্দানো মানে কী? ঘর কীভাবে বান্দাতে হয়? আর বান্দালে কী লাভ হবে?
-ভাগনার জবাব: মামা আপনি জানেন না?
-বললাম, কিছু কিছু জানি, তবে তুমি খোলাসা করে বলো।
-বললো, বাংলাদেশে মানুষ তো ঘর বান্দাইয়া নেয় । কোনো ঘরে জ্বিন-ভুত থাকলে কিংবা ‘ব্যামার-আজার’ থাকলে মেছাব দিয়ে বান্দাইয়া নেয়া যায়?
বললাম- কীভাবে বান্দায়?
বললো, ঘরের চারকোণায় চারটি তাবিজ পুতে রাখা হয়। এরপর আরো অনেক পড়াশোনা ও ঝাঁড়-ফুক আছে । তো আপনারা যদি ঘর বান্দাইয়া নেন, তাহলে হয়তো আর করোনাভাইরাস ভেতরে ঢুকতে পারবে না। বললাম- আচ্ছা, বান্দাইয়া না হয় নিলাম। কিন্তু ঘরের বাইরে যখন যাবো তখন কী হবে?
বললো- তাহলে আপনাদের পুরো এলাকাটাই বান্দাইয়া নিতে পারেন ।
বললাম, আর যখন এলাকার বাইরে যাবো তখন? তখন তো রিস্ক থেকেই যায়? তাহলে কি আমরা পুরো দেশটাই বান্দাইয়া নিতে পারিনা?
একটু থেমে জবাব দিলো ভাগনা। বললো- “পারা যায় মামা, তবে খরচ একটু বেশি পড়বে”।
আমি তাকে কী জবাব দেবো । কথা শুনে হাসতে-হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
হাসি চেপে বললাম, তুমি পুরো দেশটি ‘বান্দানো’র ব্যবস্থা করে দাও । টাকার কোনো চিন্তা করো না। আমরা এখানে টেলিভিশনে ফান্ডরেইজ করলে একরাতেই এসব টাকা তুলে নিতে পারবো । আর কিছু ঘাটতি থাকলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বললে তিনি সাহায্য করবেন বলে আশা করা যায় । কারণ তিনি নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়ে ভেন্টিলেশনে ছিলেন। এরকমন একটি ব্যবস্থা যে আছে, তিনি হয়তো জানেনই না। জানলে তিনি ও তার উপদেষ্টারা এটি লুফে নিবেন।
ভাগনা আশ্বস্ত হলো । বললো, “ঘর বান্দাওরা মেছাব তো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসতে হবে মামা” । আপনারা ভিসা টিকিটসহ অন্যান্য খরচা দিলে আমি কথা বলে দেখবো। বললাম, তুমি কথা বলে জানাও । টাকা পয়সার কোনো অসুবিধা হবে না । এই বলে ফোনালাপের ইতি টানলাম।
ফোন রেখে ভাবছি, সাধারণত বাংলাদেশে একটি ঘর বান্দাতে নাকি কমপক্ষে একটি খাসি জবাই করতে হয় । এখন ইউকের মতো একটি দেশ বান্দাইতে কতটি ভেড়া ও গরুর প্রয়োজন হতে পারে? অনায়াসে কয়েক হাজার তো লাগবেই। এগুলো কি ম্যানেজ করা যাবে?
হঠাৎ মনে হলো এই প্রস্তাব ঠিকমতো পৌঁছাতে পারলে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অবশ্যই রাজি হবেন। কারণ এর আগেও এক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী নাকি বাংলাদেশী এক পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন ।
এই কেরামতির কাহিনীটি অতি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সিলেটের এক ওয়াজ মাহফিলে জনৈক মৌসুমী ওয়াইজ (বক্তা) ভাইরাল করেছেন। ওয়াজে তিনি বলেন, বৃটেনের এক প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন । অনেক চিকিৎসা করেও তিনি সন্তানের মুখ দেখতে পারছিলেন না। একসময় তিনি বাংলাদেশী ওই পীর সাহেবের কথা জানতে পারেন। তখন তিনি বাংলাদেশী এক ব্যক্তির মাধ্যমে পীর সাহেবের কাছ থেকে একটি তাবিজ সংগ্রহ করে নিয়ে ব্যবহার করেন।
তাবিজ দেয়ার সময় ওই পীর সাহেব প্রধানমন্ত্রীকে একটি শর্ত দিয়েছিলেন । বলেছিলেন, যদি তাবিজে সুফল বয়ে নিয়ে আসে তাহলে তিনি এদেশে যেন একটি মসজিদ তৈরি করে দেন । পরবর্তীতে তাবিজ ব্যবহারের ফলে সন্তান জন্ম হয় এবং প্রধানমন্ত্রী এ দেশে মসজিদ নির্মাণ করে দেন । তখন থেকেই এদেশে মসজিদ নির্মাণ শুরু হয় এবং আজ এ দেশে শতশত মসজিদ গড়ে ওঠেছে । বৃটেনে মসজিদের বিস্তৃতি পীর সাহেবের তাবিজেরই ফসল। ওয়াজে এই কেরামতের কাহিনী শুনে শ্রোতারা আবেগে সুবহানাল্লাহ বলে উঠেন।
হুজুরের এই কেরামত কাহিনীটি আমাকে বেশ অনুসন্ধিৎসু করে তুলে । আমি এ নিয়ে কিছুটা ঘাটাঘাটি শুরু করি। আসলে কে সেই প্রধানমন্ত্রী? ওয়াজটি আবার ভালো করে কান পেতে শুনলাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম তাঁর ওয়াজ থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি-না। এক জায়গায় গিয়ে সামান্য ইংগিত পাওয়া গেল । ‘হুজুর’ বক্তব্যের এক জায়গায় বলেছেন, “তাবিজ ব্যবহারের পর আল্লাহর বান্দি একটি সন্তান লাভ করেন”।
বুঝতে পারলাম, যেহেতু তিনি বলেছেন ‘আল্লাহর বান্দি’, তাহলে ওই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মহিলা ছিলেন । আর বৃটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। তিনি ১৯৭৯ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে থেরেসা মে দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, যিনি নিঃসন্তান । ওয়াজের তথ্য অনুযায়ী, মার্গারেট থ্যাচারই যে তাবিজটি নিয়েছিলেন-এটা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
মার্গারেট থ্যাচার জমজ ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন । বড় ছেলে মার্ক থ্যাচার আর মেয়ে ক্যারল থ্যাচার । দুজনই ১৯৫৩ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাহলে পীর সাহেব তাবিজ দিয়েছিলেন ওই তারিখের কমপক্ষে ১০ মাস ১০দিন আগে ।
যাক । এবার আমি যুক্তরাজ্যে মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। ইতিহাস ঘেটে যে তথ্য পেলাম, তা ওই মৌসুমী বক্তার বক্তব্যের দ্বারে কাছেও নয়। তিনি বলেছেন, প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় পীর সাহেবের তাবিজে বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর। অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের পর।
কিন্তু ইতিহাস বলছে, যুক্তরাজ্যে মসজিদ নির্মাণ হয় পীর সাহেবের তাবিজ দেয়ার প্রায় ৬৪ বছর আগে, ১৮৮৯ সালে। প্রথম মসজদটি নির্মাণ করা হয় রাজধানী লন্ডন থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দুরবর্তী শহর লিভারপুলে । মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০ সদস্যের একদল বৃটিশ যুবক যারা ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং, তাবিজে বাচ্চা জন্মের পর মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়েছে এই বক্তব্যের কোনো সত্যতা আপাতত পাওয়া গেলো না।
তবে এবার আমার অনুসন্ধান সেই মহৎ ব্যক্তিটির খোঁজে । যিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর একটি বড়ো উপকার করে দিয়েছিলন। পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে এসেছিলেন । আমি তাঁকে খুঁজছি । পীর সাহেব কি আদৌ এ ধরনের কোনো তাবিজ দিয়েছিলেন নাকি ওই মৌসুমী বক্তা তাঁর নামে আষাঢ়ে গল্প সাজিয়েছিলেন। তাই ওই তাবিজ সরবরাহকারি ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলেই পীর সাহেবের কেরামত-কাহিনীটি পুরোপুরি পরিস্কার হয়ে যেতো ।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য। সোমবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২১।