ইউকে শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
হেডলাইন

ফরাসি বিপ্লবের মূল চেতনা ও মুক্তচিন্তার নানাদিক

ফকির ইলিয়াস : জাতিসংঘ সংবিধান আমাদের অনেকেই জানেন। কী লেখা আছে সেখানে,তা বিস্তারিত জেনেই চলছে বিশ্ব। চলারই কথা।এটা কি আমাদের সুশীল কেউ কেউ জানেন না?
না জেনে থাকলে, তারা তা পড়ে নিতে পারেন। এই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, যদি গোত্রগত সংঘাত হয়- তবে এই বিশ্বে একদিনেই লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে একে অন্যের হাতে।আমরা কি সেটা চাই? তাহলে আমরা কোন মানবতাবাদী বিশ্বের কথা বলছি? কেন বলছি?
বর্ণ,গোত্র,সম্প্রদায়,জাতি,ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে উসকে দেয়া’টা মতপ্রকাশের আওতায় পড়ে না। যদি পড়তো, তাহলে যে কেউ যা ইচ্ছে তা বলতে-লিখতে পারতো।
এমনটি বলার ‘স্বাধীনতা’ বিশ্ব গ্রাহ্য হরে না করতে পারে না।
আমরা প্রায়ই দেখি,বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আমাদের কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করে লাইমলাইটে আসতে চান। লেখায়-আঁকায়-কথায়-মতবাদে অন্য ধর্ম,ধর্মের বিভিন্ন
স্তম্ভ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে পান্ডিত্য জাহিরের পাশাপাশি নিজের প্রতি দৃষ্টি ফেরাবার প্রচেষ্টা করেন। এটা নতুন নয়। আদিকাল থেকেই তা চলছে। কেন চলছে?
এর মূল কারণ হলো,বিশ্বে সাময়িক অশান্তি সৃষ্টি করা।মানুষকে হন্য করে তোলা।
আমি যে বিষয়টি বুঝি না, যে বন্যরা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে এসব করেন- তাদের কি মানবতাবাদ নিয়ে একটুও দরদ থাকে না? তারা কি জানেন না, কোটি
মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তা চরম সংঘাতের কারণ হতে পারে!
ফ্রান্সে সাম্প্রতিক কালে যা ঘটছে, তা খুবই দুঃখজনক। ফ্রান্সে কার্টুন নিয়ে কান্ড কাঁপিয়ে তুলেছে গোটা বিশ্ব। আমরা একটি শিকড়ে যেতে চাই। আমাদের অজানা নয়, ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ওই মুলুকে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ – ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘লাইসিতে’- তা ফ্রান্সের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই “মুক্তি, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব” ফরাসী রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, কিন্তু লাইসিতে বা ধর্মনিরপেক্ষতাও সমান গুরুত্ব পায় সেদেশে।
লাইসিতের মূল কথা হলো জনসমক্ষে – তা ক্লাসরুম হোক বা কাজের জায়গায় হোক – সেখানে ধর্মের কোনো কথাই চলবে না। আর ফরাসী রাষ্ট্র এখন বলছে – কোনো একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিকে রক্ষার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ চাপালে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।
তাহলে ফ্রান্স তো নিজেই দ্বৈত নীতিতে দাঁড়াচ্ছে। যা তাদের জন্য খুবই আত্মঘাতি।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, দু’হাজার পনের সালে মহানবী (সঃ)এঁর কার্টুন প্রকাশের পর ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী ‘শার্লি এবদো’র অফিসে ১২ জনের মৃত্যু ঘটেছিল হামলায়। পর যে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল তার সাথেি এই চলতি বিক্ষোভের তুলনা করা হচ্ছে।
ক্লাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শেখাতে ব্যঙ্গ কার্টুন দেখানোর পর থেকে হুমকির ভেতরে ছিলেন প্যারিসের উপকণ্ঠে এক স্কুলের ইতিহাস ও ভূগোলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি।
কিছু মুসলিম অভিভাবক তাকে অপসারণের জন্য আন্দোলন করছিলেন। স্থানীয় একজন ইমামের নেতৃত্বে অনলাইনে এই নিয়ে প্রচারণাও চলছিল।
এরপরেই প্যাটিকে হত্যা করা হয়।
পুলিশের ভাষ্যমতে, সন্দেহভাজন ঐ হত্যাকারী মুসলিম তরুণ ৬০ মাইল দূরের এক শহর থেকে এসে ঐ শিক্ষককে খুঁজে বের করে ছুরি দিয়ে হত্যার পর তার শিরশ্ছেদ করে।
ফ্রান্সের এই আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বব্যাপি। ফ্রান্সের বিভিন্ন সামগ্রি বয়কটের ডাক দিয়েছে অনেকগুলো দেশ।
প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্রর মন্তব্যের জের ধরে ফরাসি পণ্য বর্জন না করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। এর আগে ম্যাঁক্র মহানবী(সঃ)এঁর কার্টুন দেখানের পক্ষে সাফাই দিয়েছিলেন।
কুয়েত, জর্ডান এবং কাতারের কিছু কিছু দোকান থেকে ফরাসি পণ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া লিবিয়া, সিরিয়া এবং গাজা উপত্যকায় বিক্ষোভও দেখা গিয়েছে।
উল্লেখ্য, শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করার একটি ঘটনাকে ‘ইসলামি সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে ফরাসী রম্য সাময়িকী শার্লি এব্দোর অফিসে ইসলামপন্থীদের যে হামলা হয়, তার সাথে জড়িত সন্দেহে ১৪জন কথিত ষড়যন্ত্রকারীর বিচার শুরু হয়েছে।
বিচার শুরুর একদিন আগে শার্লি এব্দো নবী (সঃ)কে নিয়ে বহুল বিতর্কিত কিছু কার্টুন আবার প্রকাশ করেছে, যে কার্টুন প্রকাশের জেরে ২০১৫ সালে তাদের অফিসে হামলা চালানো হয়েছিল।
কথিত ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, শার্লি এব্দোতে ২০১৫-র ৭ই জানুয়ারি দুই ভাই-এর চালানো বন্দুক হামলায় সহযোগিতা করেছিল এই ১৪জন।
সুপরিচিত কার্টুনিস্টসহ ১২ জন ওই হামলায় নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর প্যারিসে এই ঘটনা সংক্রান্ত আরেকটি হামলায় পাঁচজন মারা যায়।
কট্টরপন্থী বলে পরিচিত ফ্রান্সের একটি জনগোষ্টি দ্বারা শার্লি হেবদোর কার্টুন দেখানো হচ্ছে অসংখ্য বহুতলে। তাঁরা জানাচ্ছেন, যারা গণতন্ত্রের শত্রু, যারা ধর্মকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সামনে কোনওমতেই দুর্বল হওয়া চলবে না।
অবস্থা ক্রমশ আঁধারের দিকেই যাচ্ছে। ‘বিশ্বাসের স্বাধীনতার’ প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করার জন্য ও ফ্রান্সের লাখ লাখ মুসলিমকে অবজ্ঞা করার জন্য ম্যাক্রোঁর তীব্র সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়িপ এরদোয়ান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ইসলাম নিয়ে ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বিরোধের জেরে জনগণের প্রতি ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন এরদোয়ান।
এর আগে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছে ফ্রান্স। ধর্মনিরপেক্ষ ফরাসি মূল্যবোধ সুরক্ষিত রাখা এবং মৌলবাদী ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছেন ম্যাক্রোঁ। আর এ কারণে তার ‘মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার’ বলে মন্তব্য করে বসেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, একটি মানবিক চেতনার মঘ্য দিয়েই ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব ছিল ফরাসি বিপ্লবের মূল স্লোগান। ১৭৮৯-১৭৯৯ সময়কাল ছিল ফ্রান্সের ইতিহাসে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি দুর্যোগপূর্ণ অথচ পরিবর্তনের দশক। এসময় পূর্বেকার পূর্ণ রাজতান্ত্রিক সরকার কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে এবং নতুনভাবে জনগণের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিলুপ্ত হয় ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা অভিজাত, ক্যাথলিক সম্প্রদায় এবং সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার। এ বিপ্লব ফ্রান্সের গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শে দেশের জনগণসহ সারাবিশ্বকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আজও সারা বিশ্বময় শোষণের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লব একটি জাগ্রত চেতনা।
একটি বিপ্লব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা কারণে সংগঠিত হতে পারেনা। বরং একটি নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়। ফরাসী বিপ্লবও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তৎকালীন ফ্রান্সের অন্যতম সমস্যা ছিল খাদ্যসংকট তথা অর্থনৈতিক সংকট। উপরন্তু বিপ্লবের অল্প কিছুপূর্বে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে বৈদেশিক সাহায্য থেকেও বঞ্চিত এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ফ্রান্সের রাজতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
প্রায় এক দশক সময় ধরে চলা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল অবস্থা অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ ভাগে এসে স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল হয়। ১৭৯৯ সালের দিকে ফ্রান্সের বিপ্লব তথা ‘ফরাসি বিপ্লবে’র পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সফলতার চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানেও ফ্রান্স একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই চেতনা আজ কোথায়?
বিশ্ব এখন মহামারীকালীন সময় অতিক্রম করছে। এই সময়ে ‘হিউম্যান-মেইড প্রবলেম’ আর সইতে পারছে না বিশ্ব। আমি যে বিষয়টি বুঝি না, তা হলো
না না অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে সেশন হয়। কিন্তু বৈষম্য ও ধর্ম-গোত্রগত সংঘাতের বিষয়টি সেশনে গুরুত্ব পায় না কেন? কেন
মনে করিয়ে দেয়া হয় না জাতিসংঘ সংবিধানের চৌহদ্দি ? কী সীমারেখায় চলবে মানবতাবাদের বিশ্ব। নাকি কেউ কেউ চান, সংহাত লেগেই থাকুক!
আমরা বিশ্বে শান্তি চাই। উসকে দিয়ে সংঘাত আর মুক্তচিন্তা প্রকাশের নামে হানাহানি কারও কাম্য হতে পারে না।এটি বিশ্বে আজ গুরুত্বের সাথে আলোচিত,
প্রাধান্য পাওয়া দরকার।ফ্রান্সে যে অভিবাসী সমাজ রয়েছেন, তারা না না ভাবেই শংকাগ্রস্থ। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ফরাসী সরকারকেই নিতে হবে।আর তারাও
সেই দেশের আইন কানুন মেনে চলবেন- সেটাই প্রত্যাশিত। উগ্রতা নানাভাবেই হতে পারে। কলমে,কন্ঠে,আচরণে,অস্ত্রে- বিভিন্ন ভাবেই তা করা যায়। মনে রাখা
দরকার, মহানবী হযরত মোহাম্মদ(সঃ) এর কোনও ছবি ছিল না।নেই। অথচ এখন তাঁর ছবির কার্টুন বানানো হচ্ছে।
১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত খ্যাতিমান গবেষক,লেখক Michael H. Hart
এর The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History বইটিতে প্রথম যে নামটি এসেছে তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ(সঃ)।
উইকিপিডিয়াতে তা যে কেউ দেখে নিতে পারেন। সেখানেও আরবীতে শুধু নাম দেয়া হয়েছে। বাকীদের ছবি দেয়া আছে।
তাহলে এখন বিনা কারণে এই খুঁচাখুঁচি করা হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? পুরো বিশ্বকেই শান্তির পক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ মতে পৌঁছুতে হবে। তা হলে
মানুষ ক্রমশ হানাহানিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যা আমাদের কারওই কাম্য নয়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com