
ইউকে বাংলা অনলাইন ডেস্ক : সম্প্রতি একটি বিতর্ক প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। বিতর্কটি হলো দুর্নীতির রেকর্ড কোন দলের বেশি? এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, কাজেই আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজের সংখ্যাও বেড়েছে, বাড়ছে। অনেক দেশেই ক্ষমতা এবং দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলে। করোনাভাইরাসের সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি নগ্নভাবে সামনে আসছে। আওয়ামী লীগ এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তার মানে কি এই যে এর আগে যেসব দল দেশ শাসন করেছে তাদের আমলে দেশে দুর্নীতি ছিল না? বিএনপি-জামায়াত আমলে কি দেশ টানা চারবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়নি? এরশাদ আমলে কি কম দুর্নীতি হয়েছে?
আমাদের দেশে কিছু নিরপেক্ষ লেখক-চিন্তক আছেন, যাদের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে একধরনের রিজার্ভেশন আছে। তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় আনন্দ পান, বিএনপির সমালোচনায় মনে কষ্ট পান। বিএনপির দুর্নীতি-অনিয়মের কথা বললে তারা আহত হয়ে বলেন, এখন বিএনপির সমালোচনা কেন? বিএনপির পাপের শাস্তি বিএনপি পেয়েছে। এত বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এখন টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ এবং তারা এখন দেশটাকে লুটপাটের ভাগার বানিয়েছে। তাই এখন সমালোচন করতে হবে আওয়ামী লীগের। কথা মিথ্যা না।
আমরা যখন দেশের জিম্মাদার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে বানিয়েছি, তখনই বড় ভুল করেছি। আমরা, বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী এটা মেনে নিয়েছি যে, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করবে। এখন এই ধারায় পরিবর্তন আসায়, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় ওই নিরপেক্ষ চিন্তকদের গায়ের জ্বালা বেড়ে গেছে।
বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে বলে কি বিএনপির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে? বিএনপি কি তাদের অতীত রাজনীতির ত্রুটি-বিচ্যুতির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না? প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে হত্যা-খুনের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না? না, এমন কোনো পরিবর্তন বিএনপিতে দৃশ্যমান নয়?
আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বিএনপি ভালো না হলে আওয়ামী লীগ ভালো হবে না। দেশে খারাপ রাজনীতি চালু করেছে বিএনপি। সেটা করেও দলটির জনপ্রিয় হতে অসুবিধা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকে অনুসরণ করছে। যে যত তত্ত্বকথাই বলুন না কেন, এখন রাজনীতির মাঠের বাস্তবতা হলো হয় আওয়ামী লীগ, না হয় বিএনপি। মানুষের মনোজগতে আমরা তো এটাই প্রোথিত করেছি যে আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি।
আমরা এটাও ভুলে বসে আছি যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে তার রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে সময়ে সময়ে পরিবর্তন এনেছে- মধ্যডান থেকে মধ্যবাম, মধ্যবাম থেকে বামের দিকে ঝুঁকেছে, তার একটি বড় কারণ তখন আওয়ামী লীগের প্রতিযোগিতা ছিল ভালোর সঙ্গে। তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতাও ছিল বাম বা বামমুখী। আওয়ামী লীগ তখন ভালোর জন্য ভালোর (বাম) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজে ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের মানুষ ভালোকে (বাম) বর্জন করে খারাপকে (বিএনপি) গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ক্রমে খারাপের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।
বলা হবে, মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনাই তো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের ধারণা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন, আবার তিনিই পাকিস্তানবিরোধিতাও প্রবল করেছিলেন। এখন জনমত পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্ব নেই? হ্যাঁ, সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ কৌশল বদলেছে। সুফল পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতবদল, পথবদলের সবকিছু কি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন করেছেন? আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের খারাপ কাজের সমালোচনা করেন। ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আওয়ামী লীগের নমনীয়তা বা আত্মসমর্পণ কারও কাছে প্রশংসিত হয়নি। সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে তার বেনিফিট গিয়ে জমা হয় বিএনপির তহবিলে।
বিএনপির সমর্থক কি বিএনপির কোনো খারাপ কাজের সমালোচনা করেন? তারেক রহমানের দুর্বৃত্তির কোনো সমালোচনা ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ করেছেন? হাওয়া ভবন নামের বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে আওয়ামী লীগ-নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়নের মতো ঘৃণ্য কাজের কোনো নিন্দা-সমালোচনা বিএনপি-দরদী কেউ করেছেন?
বলা হবে, বিএনপি তো খারাপ। বিএনপির কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল। আওয়ামী লীগ কেন কুপথে যাবে, খারাপ করবে? যারা এমন বলেন, তারা আসলে মেকি বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সহযোগীদের প্রতি যাদের দরদ প্রচ্ছন্ন নয়- তারা কি খুব ভালো মানুষ?
নিরপেক্ষ দাবিদাররা আমাকে আওয়ামী দালাল বলে নিন্দামন্দ করতে পারেন। বিদেশি রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকদের ভারী ভারী সব কিতাব থেকে বাণী উদ্ধৃত করে সবক দিতে পারেন কিন্তু আমি তাদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ করব, আপনারা চক্ষু মেলিয়া দুই পা ফেলিয়া বাংলাদেশটাকে দেখুন। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় সাধারণ বাঙালির মনন-চিন্তন দিয়েই।
মানুষ এখন অনেক কিছু শিখেছে। মানুষ এখন কেবল ক্ষমতার (দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মের) হাতবদল চায় না। মানুষ আওয়ামী লীগের চোর-বাটপারদের বদলে বিএনপির চোর-বাটপারদের ক্ষমতা দিতে চায় না।
বিএনপি অঙ্গীকার করুক, ক্ষমতায় গেলে পুরোনো ধারার রাজনীতির বদলে সামনে তাকিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করবে, কোনো ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না এবং এবং অন্তত জনাপঞ্চাশেক নীতিনিষ্ঠ মানুষের নাম বলুক যাদের দিয়ে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হবে, তাহলে আমিও তিন তালি দিয়ে মুক্তকণ্ঠে বিএনপির জয়ধ্বনি দেব।
সেটা না হলে কি আওয়ামী লীগের চুরিধারি মুখবুজে মেনে নিতে হবে? অবশ্যই না। আওয়ামীলীগকে দুর্নীতির বিরুদ্ধ কঠোর হতে হবে। দু-একজন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনাম গিলে খাওয়া হাঙরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দুর্নীতি নির্মূলে কঠোরতা না দেখালে শেখ হাসিনার একক সততা দিয়ে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করা যাবে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।