ইউকে সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

সকালবেলা’র গল্প

◽️রওনক ওয়াফা◽️

সকালবেলা। বেশ সুন্দর সকাল। মেঘ পরিষ্কার রোদ্দুর। চড়ুই দম্পতির কিচিরমিচির আওয়াজ। সবকিছুই দারুণ। এর মধ্যেই হঠাৎ বাতাসের ঝামেলা শুরু হলো। দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস হবার কথা। উত্তর দিক থেকে হতে শুরু করলো। প্রকৃতিতে বড় কোনো নড়চড় হচ্ছে কি? শরীরটা বেশ ভালো লাগছে। এই অবস্থায় প্রকৃতির নড়চড় ভালো লাগবার কথা না। আমি কি লিখবো। ডেইলি স্টারের জন্য প্রকৃতির নড়চড় বিষয়ক ইংরেজি একটা আর্টিকল? নাকি বাংলা কিছু কথা? চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ভাবতে হবে। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
এই হলো গল্প লিখবার ভূমিকা।।

আপনার নামটা এমন কেনো বলুন তো? অদ্ভুত টাইপ। কবুল! আমি আজ পর্যন্ত কারো নাম যে কবুল হয় এমন শুনিনি। আমার মনে হয় আপনি নিজেও শুনেননি। শুধু শুনেননি তাই না। এ নিয়ে আপনি বেশ বিভ্রান্তিতেও ভুগেছেন। সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিতে ভুগেছেন স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়বার সময়। আমি কি ঠিক বলেছি?

আমার ভাইয়ার নামও আপনার নামের মতো ‘ক’ দিয়ে শুরু এবং অদ্ভুত। অবশ্যি আপনার নামের মতো অতোটা অদ্ভুত না। অল্প অদ্ভুত। ওর নাম ‘কাপাশ’। মীরা আপা ওর এই অল্প অদ্ভুত নাম নিয়ে একবার তার চিঠিতে লিখলেন, ‘প্রিয় কাপাশ, তোমার নাম কাপাশ না হয়ে সাপাশ হলে খুব ভালো হতো। কেনো বলছি জানো? কারণ সাপাশ অর্থ সাপ+আঁশ= সাপের আঁশ। হাহাহা।’ মীরা আপা ভাইয়ার ইউনিভার্সিটির বান্ধবী। জ্যুলোজিতে পড়েন। জ্যুলোজিতে পড়েন বলেই তিনি সবসময় পশু-পাখি বিষয়ক আলোচনা করতে ভালোবাসেন। একবার তিনি আমাকে একটা প্রাণীর কথা বললেন। প্রাণীর নামটা কঠিন বলে আমার মনে নেই। মীরা আপার স্মৃতিশক্তি ভালো। তিনি কঠিন কঠিন প্রাণীর নাম মনে রাখতে পারেন। আমার ধারণা, এই প্রাণীর নাম আপনি একবার শুনলেই মীরা আপার স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন। মীরা আপা বললেন, মেয়েরা সাধারণত যে ব্রুচ পড়ে সেগুলো নাকি ঐ প্রাণীর হাগু থেকে সিনথেসিস করা হয়। এর বড় স্টক হচ্ছে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে। এই ভয়াবহ কথাটা শুনবার পর আমার কি অবস্থা হয়েছিলো জানেন? থাক। আপনার জানবার দরকার নেই। আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার নীল শাড়িতে কাঁটা ব্রুচটা নেই কেনো? আমি সেদিন কোনো উত্তর দেইনি। উত্তরটা আজ দিলাম।

আপনি এখন কেমন আছেন? শেফালীর কাছে খবর পেলাম আপনার নাকি খুব পেটে ব্যথা। ডায়রিয়া না আমাশা টাইপ কিছু একটা হয়েছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন। ঠিকমতো উঠ-বোস করতে কষ্ট হয়। ধরে বেঁধে খাওয়াতে হয়। শেফালী একবেলা নিজ হাতে বসিয়ে ধরে বেঁধে আপনাকে খাইয়েও দিয়েছে। এ অবস্থা সত্য হলে আপনার ভালো থাকবার কথা না। আপনার এই নিদারুণ অবস্থার কথা শুনে বাবা প্রচন্ড চিন্তায় পড়েছেন। বাসার সবাইকে বলেছেন যেনো আমরা সবাই আপনার জন্য দোয়া করি। এ কথা শুনে দয়া করে খুশি হবেননা। কারণ আপনার জন্য কেবল বাবা ছাড়া আর কেউ দোয়া করছেনা। না করার পেছনে কারণ আমাদের বাসার বাকী সব লোক অ্যাপোস্ট্যাট টাইপ। ভাইয়া সকাল সন্ধ্যা ভার্সিটিতে দৌঁড়াচ্ছে। সে নাকি কিসের ডালপালা জোগাড়ে আছে। বিয়ের পরপরই কবিরাজি শুরু করে দিবে। ভাইয়া বিয়ে করবে মীরা আপাকে। এই বছরের সেপ্টেম্বরে বিয়ে। রোখছতি অক্টোবরে। মধুচন্দ্রিমা নভেম্বরের পয়লা সপ্তাহের কোনো একদিন থেকে শুরু হবে। চলবে এক সপ্তাহ। মধুচন্দ্রিমার জন্য সেইন্ট মার্টিন বেস্ট। তাই তারা দুজন সেইন্ট মার্টিন যাবে। সেইন্ট মার্টিনে এখন নাকি আবার জাহাজ যায়। নতুন জাহাজ। নাম ঈগল মেরিন ট্রাভেলস। এসব নিয়ে ভাইয়ার মোটামুটি বিরাট প্ল্যান চলছে। যদিও কেনো যেনো আমার ধারণা ভাইয়ার সাথে মীরা আপার বিয়ে হবেনা। মীরা আপার বিয়ে হবে অন্য কোথাও। আমার ছোট বোন শীলারও দোয়া করবার সময় নেই। সারাক্ষণ ও বই নিয়ে পড়ে থাকে। জগৎ সংসার নিয়ে ওর মাথাব্যথা সর্বনিম্ন। ওর এই সর্বনিম্ন মাথাব্যথা ব্যাপারটা নিয়ে বাবা বেশ দুশ্চিন্তা করছেন। বাবার ধারণা বই পড়তে পড়তে তার মেয়ে রোবট হয়ে গেছে। আবেগ অনুভূতি বাষ্পীভূত হয়ে অন্তর পাথর হয়ে গেছে। বাবার কাছে আবেগ অনুভূতি হচ্ছে পানিবিশেষ পদার্থ। অন্তরে যার যতো পানি সে ততো ভালো মানুষ। এই পৃথিবীতে যার অন্তরে সবচেয়ে বেশি পানি ছিলো তিনি মুহাম্মদ (সা)। আমার ধারণা কি জানেন? আমার ধারণা ওর নামের জন্যই ওর এরকম অবস্থা। ওর নাম শীলা। শীলা অর্থ হচ্ছে পাথর। ওর নাম ঘুরিয়ে সিন্ধু রাখা হলেই দেখা যাবে সব ঠিক হয়ে গেছে। সব শীলা গলে পানি হয়ে গেছে। তখন ও শুধু কাঁদবে। ভাইয়ার বিয়ে হচ্ছে। আর শীলা দরদর করে কাঁদছে। কি অদ্ভুত হবেনা ব্যাপারটা? এখন বাকী রইলাম আমি। আমি হচ্ছি শীলার উল্টো। পড়াশুনা তেমন করিনা। কলেজের নাম করে গাড়ি নিয়ে বের হই। অধিকাংশ সময় ক্লাসে না গিয়ে ঘুরাঘুরি করি। মোছাদ্দেক মিঞাকে একশো করে টাকা দেই যেনো সে আমার এই ঘুরাঘুরির ব্যাপারটা বাবাকে না জানায়। মোছাদ্দেক মিঞা স্বল্প চাহিদার মানুষ। একশো টাকা পেয়ে খবর গোপন রাখে। শুধু গোপন রাখে তাই না। কেউ সন্দেহ করে কিছু জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলে দেয়। এই মিথ্যা আমি তাকে বলতে বলিনি। সে নিজে থেকেই বলে।
দুনিয়ায় মহামানব আর কুখ্যাত মানবের মিলটা কোথায় জানেন? মিলটা হচ্ছে এরা দুজনই স্বল্প চাহিদার মানুষ। কুখ্যাত মানুষরা অল্প কিছুর লোভেই সাংঘাতিক কাজ করে বসে। এদের থেকে সাবধান থাকবেন। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন এই ঘুরাঘুরি বিষয়ক গোপন কথা আমি আপনাকে কেনো বলছি? আমার বলবার কারণ আছে বলেই বলছি। আমার ইচ্ছে এই চিঠি পড়ে আপনি আমার সম্পর্কে খুব খারাপ একটা ধারণা করেন।

এই মুহূর্তে আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরছি। শনিবার হওয়ায় রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। মোছাদ্দেক মিঞা পাকা ড্রাইভার। খুব জ্যামের সময়েও দেখা যায় সে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। আজ তাকে দ্রুত গাড়ি চালাতে নিষেধ করেছি। ধীরে ধীরে গাড়ি চলবে। আমি আশপাশ খুব ভালো করে পরখ করবো। এই ব্যবস্থা। আমি ইচ্ছে করলে বাসায় চলে যেতে পারি। কিন্তু বাসায় ফিরতে মন করছেনা। শহরটাতে চক্কর দিতে মন করছে। চাইলে আপনার ওখানেও চলে আসতে পারি। আজ আসবোনা। ভেবে রেখেছি কোনো একদিন আমি হুট করে আপনার ওখানে চলে আসবো। এসে আপনাকে দেখে যাবো। অপ্রস্তুত পরিস্থিতি আপনি কি করে সামাল দেন তার একটা ছোট্ট পরীক্ষা করে ফেলা যাবে। কি বলেন?
আমি বসে আছি মোছাদ্দেক মিঞার ঠিক পেছন সিটে। মোছাদ্দেক মিঞা লুকিং গ্লাস দিয়ে মাঝেমাঝেই আমাকে দেখছে। আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। সে পারছেনা। মোছাদ্দেক মিঞার এই দেখবার পেছনের রহস্য কি জানেন? খুব সহজ রহস্য। পৃথিবীর প্রতিটা মেয়ে জানে ঠিক কিরকম এক্সপ্রেশনে তাকে আকর্ষণীয় দেখা যায়। ইংরেজিতে একে বলে, Sense of appealing look। আমি এখন সেরকম লুক দিচ্ছি। মোছাদ্দেক মিঞা এই লুকের আকর্ষণে পড়েছে। লোভ সামলাতে না পেরে বারবার তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? আমি মাঝেমাঝেই এমনটা করি। অনেক পুরুষ লোকের সাথেই করি। এরা সবাই টোপ গিলে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক পলকে তাকিয়ে থাকেনা। বারো পলকে তাকিয়ে থাকে।
এক পলকে বিশুদ্ধ প্রেম,
বারো পলকে বিষ।
এক আনাতে প্রেম নিবেদন,
বারো আনায় শিষ।।

আমি খারাপ মেয়ে হলেও আমার আশেপাশের মানুষদের প্রতি আমার ধারণা খুব ভালো। আমি খুব খারাপ মানুষদের মাঝেও ভালো গুণ ধরতে পারি। যেমন আমার মা। আমার মা ছিলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার। খুব ব্যস্ত ছিলেন বলেই ছোটবেলা থেকে আমরা দু বোন মা’র আদর খুব কম পেয়েছি। এই খুব কমের বিরাট অংশ ছিলো রাতের বেলা ঘুমোবার সময়। শিলা আগে থেকেই ছিলো ঘুমকাতুরে মেয়ে। বিছনায় শুয়েই টুপ করে ঘুমিয়ে পড়তো। আমার সহজে ঘুম ধরতোনা। ঐ সময় আমি মা’র সাথে এটা সেটা গল্প করতাম।
– মা।
– বল।
– বাবার উপর তুমি রাগ করেছো?
– হুম।
– খুব রাগ?
– হুম। খুব রাগ।
– বাবার সাথে সত্যি সত্যি আর কথা বলবেনা?
– না। বলবোনা।
– কোনোদিন বলবেনা?
– না।
– বাবা যদি এসে তোমাকে বলে বাবা শ্বাস নিতে পারছেনা। শ্বাস আটকে আসছে। তাও বলবেনা?
– না। বলবোনা।
– বাবার এ অবস্থা দেখে ভয়ও পাবেনা?
– এটা ভয় পাবার মতো অবস্থা হলে পেতাম। এটা ভয় পাবার মতো অবস্থা না।
– বাবা শ্বাস নিতে পারছেনা, এটা ভয় পাবার মতো বিষয় না?
– না। যে লোক শ্বাস নিতে পারছেনা সে কথা বলবে কি করে? কথা বলতে হলে শ্বাস নিতে হয়। তোর কথামতো তোর বাবা যদি এসে আমাকে বলে সে শ্বাস নিতে পারছেনা সেটা হবে মিথ্যা বলা। তাই ভয় পাবোনা।
– এতো বুদ্ধি কোথা থেকে পেয়েছো মা?
– বই পড়ে পেয়েছি।
– ও। আচ্ছা মা, তুমি কি কখনোই সহজে কারো কথা বিশ্বাস করোনা?
– না। করিনা।
– তোমার রোগীদের কথা?
– না। তাদের প্রথম কথা বিশ্বাস করিনা।
– কেনো মা?
– মানুষের নিজেদের রোগ নিয়ে ভুলভাল বলবার প্রবণতা আছে। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ভুগে রোগ তাদের মধ্যে ভ্রম তৈরি করে। তখন তারা ভুলভাল বলে। তাই বিশ্বাস করিনা। পৃথিবীর তিন পারসেন্ট ডাক্তার এমনটা করে। রোগীর প্রাইমারি কথা উড়িয়ে দেয়। আমি তাদের একজন।

মা কে নিয়ে এই গল্পটা আমি অনেকের সাথে করেছি। আপনার সাথেও করলাম। এই গল্প শুনে সবার ধারণা হয় আমার মা ছিলেন একজন বুদ্ধিমতী মানব সেবিকা। বাস্তবে কিন্তু তা না। আমার মা হচ্ছেন একজন ভয়ংকর ক্রিমিন্যাল। মা তখন দিনাজপুর মেডিকেলে চাকরী করেন। আমরা ভাই বোন সবাই ঢাকায় আমাদের হাতিরপুলের বাসায় থাকি। বাবা জাহাজ করে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান। আমাদের দেখভালের জন্য সাবিনা ফুপু আমাদের সাথে থাকেন। ফুপুর তখনো কোনো সংসার হয়নি। ইউনিভার্সিটিতে এম,ফিল করছেন। এই অবস্থায় একদিন হুট করে বাবা দেশে ফিরলেন। বাবা সাধারণত পনেরো বিশদিন আগে থেকে চিঠি লিখে বেশ আয়োজন করে আসেন। এবার হুট করে চলে আসলেন। সন্ধ্যা বেলায় ভাইয়া আমাদের দু বোনকে ডেকে বললো,”কিরে তোরা বুঝেছিস বাবা হুট করে কেনো চলে এসেছেন?” আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,”না বুঝিনি তো।” শীলা বললো,”কেনো এসেছে ভাইয়া? বাবাকে কি ফায়ার করে দিয়েছে?” ভাইয়া বললো,”আরে ধূর গাধীর দল। বাবাকে ফায়ার করতে যাবে কেনো? বাবা এসেছেন মা’র সাথে দেখা করতে। প্রেমের টানে। এই প্রেমের নাম হাওয়া মে উরতি মুহাব্বত। দেখিস যেকোনো সময় বাবা আমাদের নিয়ে দিনাজপুর চলে যাবেন। হাহাহা।” আমার ধারণা, ভাইয়ার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। সবকিছু সে কিভাবে যেনো আগে থেকে বুঝে ফেলে।
ভাইয়ার কথা সত্যি হলো। ডিনারের টেবিলে বাবা সবাইকে বললেন, “বাচ্চারা আমাদের সবার উচিত তোমাদের মা’কে সারপ্রাইজ দেবার জন্য আগামীকালই দিনাজপুর চলে যাওয়া। এর ফলে কি হবে? এর ফলে তোমাদের মা তোমাদের দেখে খুব খুশি হবে। ফলতঃ তোমরা তোমাদের মা’র অতি খুশির আহ্লাদি আদর ভালোবাসা পাবে। তোমাদের মা’র বহুমুখী ভালোবাসার রূপ তোমরা কখনো দেখোনি। এবার দেখতে পাবে। শি ইজ এ ভেরি মিরাকল লেডী।” বলতে বলতেই বাবা হাসলেন। সুন্দর করে হাসলেন। যে হাসির অর্থ আমরা সবাই বুঝতে পারলাম।
দিনাজপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যালগ্নে মা’কে দেখে আমরা সবাই অবাক। মা’র পেটে বাচ্চা এসেছে। বয়স পঁচিশ সপ্তাহ। বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘হোয়াট ইজ দ্যাট? এ খবর তুমি আমাকে বলোনি কেনো?’ মা বিরক্তস্বরে বললেন,’মানুষ কতো খবর গোপন করে। আমি ভেবেছি এই খবরটা গোপন করবো। বাবু হলে ওকে কোলে নিয়ে সোজা ঢাকায় চলে যাবো। বাসার দরজায় গিয়ে বেল টিপবো। দরজা খুলে দেখবে আমার কোলে একটা বাবু। তোমরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছো। তোমাদের চোখে হাজার বিস্ময়। আমি তোমাদের বিস্ময় দেখে খিলখিল করে হাসছি।’ মা’র কথায় বাবা আহত হলেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি এবার দিনাজপুর এসে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। আমরা সবাই আহত হলাম। কেবল সাবিনা ফুপু ব্যাপারটা সহজভাবে নিলেন না। তিনি সন্দেহ করতে থাকলেন। এই সন্দেহের দোলাচালেই বাবু ভূমিষ্ট হলো। ছেলে বাবু। চেহারা দেখতে হুবুহু মা’র মতো সুন্দর। বড় বড় চোখ। দেখলেই মায়া লাগে। আমি সারাদিন ওকে নিয়ে পড়ে থাকি। সঙ্গ ছাড়িনা। মা মাঝেমাঝে আমাকে বলেন, ‘রুকু, তুই ওকে খুব ভালোবাসিস তাই না?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ মা। খুব ভালোবাসি। সবার চাইতে বেশি ভালোবাসি।’ মা আমার কথা শুনে হাসেন।
একদিন আমার মমতাময়ী মা এই বাবুকে নিয়ে দিনাজপুর চলে গেলেন। আমি খুব মন খারাপ করলাম। (খুব মন খারাপ করলাম কারণ সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙবার আগেই মা বাবুকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।) এরপর যা হলো তা আমার জন্য খুব ভয়ংকর। মা দিনাজপুরে তার ডর্মিটরিতে আত্মহত্যা করলেন। আত্মহত্যা করবার আগে বাবুকে কেটে চার টুকরো করলেন। আমরা খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। ততোক্ষণে পুলিশ ডর্মিটরি ঘিরে ফেলেছে। লাশ অটোপসি করতে নিয়ে গেছে। পুলিশ আমাকে একটা খোলা চিঠি দিলো। মা মৃত্যুর আগে আমাকে সম্বোধন করে একটা চিঠি লিখে গেছেন। তিনি যেটুকু লিখেছেন তা হলো- রুকু, পুরো ঘটনা খুব নৃশংস হয়ে গেছে, তাই না মা? আমি জানি তোর মনে এখন হাজার প্রশ্ন খেলছে। তোর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। এই বাবু তোর আপন ভাই না। আমি দিনাজপুর থাকবার সময় এই ঘটনা ঘটেছে। তোর বাবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমি চেয়েছিলাম বাবুর ব্যাপারটা তোরা কেউ জানবিনা। আমি ওকে আলাদা বড় করবো। কিন্তু ঐদিন তোরা সবাই অপ্রত্যাশিতভাবে দিনাজপুর চলে আসলি। তখনই আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। ঐদিন থেকেই চোখে মৃত্যু দেখতে শুরু করলাম। আমি এরপরও তোদের কথা ভেবে বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টা করলাম। পারলামনা। আমি দেখলাম তুই বাবুকে যখন আদর করছিস তখন আমার বুক কষ্টে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এ সত্য প্রকাশ হয়ে গেলে তুই আমাকে কি চোখে দেখবি? এই ছোট্ট ছেলেটাকে কিভাবে দেখবি?- ভেবেই আঁতকে উঠছি। সবশেষ সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর বাঁচবোনা। আমার ছেলেকেও বাঁচতে দিবোনা। তাই ওকে হত্যা করে আত্মহত্যা করলাম। আমি জানি এই কথা এখন তোদের জন্য বিশ্বাস করা শক্ত। তাও বলছি। তোর বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করিস আর অনেক ভালো থাকিস।

আপনার কি ধারণা আমি আমার মা কে ক্ষমা করেছি? আমি মা কে ক্ষমা করেছি। তিনি যদি কাকতালীয়ভাবে এখন বাবুকে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ান আমি দৌঁড়ে গিয়ে দুজনকে জড়িয়ে ধরবো।

আপনাকে নিয়েও আমার ধারণা আছে। ভালো ধারণা। আপনাকে নিয়ে যে ভালো ধারণা আছে তা আমি লিখে রেখেছি যেনো কখনো ভুলে না যাই। আমি লিখেছি, A man met me today. I saw his appearance being cowered. Why?
A jeoparded life
Perspired but glistening so tight
With a pair of diaphanous eyes
He dreams about only lucid sights…..

আপনার কাছে থেকে কেউ কোনোদিন তার স্বপ্নের ব্যখ্যা শুনতে চেয়েছে? আমার ধারণা শুনতে চায়নি। আপনার চেহারার মধ্যে সারল্য আছে। এই সারল্য কোনোকিছুর ব্যখ্যা করতে জানেনা। সবকিছু ব্যখ্যাতীত ভেবে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে জানে। সেই হাসির শব্দ খুব সুরেলা। আমি এখন আপনাকে আমার একটা স্বপ্নের কথা বলবো। আপনি এর ব্যখ্যা দিবেন। গতরাতের স্বপ্ন। আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমি আর শীলা আপনার দিকে ছুটছি। আমাদের দুজনকে দেখতে সম্ভবত খুব ভয়ংকর লাগছে। কারণ আপনি আমাদের দেখে দৌঁড়ে পালাবার চেষ্টা করছেন। আমাদের দুজনের ঠোঁট বেয়ে সেবের টুথ বের হয়ে আছে। ভ্যাম্পায়ারদের মতো। এটাই হয়তো আমাদের ভয়ংকর দেখানোর সম্ভাব্য কারণ। নখের কথা মনে নেই। নখ লম্বা হতে পারে। খাটোও হতে পারে। আমরা দু বোন মাটি থেকে একটু উপর দিয়ে উড়ে আসছি। আপনি প্রচন্ড জোরে ছুটছেন। ছুটতে ছুটতে একসময় মাটিতে পড়ে গেলেন। আমরা আপনার কাছে আসলাম। এরপর শীলা আপনার ঘাড়ে কামড় দিয়ে রক্ত খেতে শুরু করলো। বেশ খাণিকক্ষণ খাবার পর আমি ওকে বললাম, শীলা আর খাস না। বেচারা মরে যাবে। শীলা কোনো কথা বললোনা। আপনার রক্ত খেয়েই গেলো। এরপর হঠাৎ করে দেখলাম শীলা আর আপনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি চিৎকার করে ডাকলাম আপনাদের। কোনো সাড়া পেলামনা। চারদিক অস্পষ্ট হয়ে আসলো আমার।
স্বপ্ন ওখানেই শেষ। আপনি খুব দ্রুত এই স্বপ্নের ব্যখ্যা বের করবেন। আর লিখতে মন করছেনা।
ইতি,
রুকাইয়্যাহ

যবনিকা: মীরা আপার প্রাণীটার নাম মনে পড়েছে। একথিওসরাস। আইস এইজের প্রাণী। নামটা কঠিন না?
আপনার শরীর ভালো না শুনবার পর থেকে আমার মন খারাপ। আচ্ছা আপনি নিজের যত্ন নিতে পারেননা? নিজের যত্ন নিবেন। নিতে না পারলেও নিবেন।
চিঠির শুরুতে খালি বাক্স রেখেছি। সেখানে আপনি নিজের নাম লিখে নিবেন। যেভাবে করে লিখতে মন করে সেভাবে লিখে নিবেন। এ স্বাধীনতা আপনার হাতে দিলাম।
(আপনার নাম সম্বোধন করে লিখতে গিয়ে আটকে গেলাম বলেই আপনার হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছি। মীরা আপার মতো করে প্রিয় কবুল লিখবার সুযোগ আমার নেই। কারণ আপনার সাথে আমার সম্পর্ক প্রিয় প্রিয়ার মতো না। শুধু কবুল লিখতেও কেমন যেনো লাগলো। কবুল, কবুল, কবুল। How strange!)

 

২৫ মার্চ ২০২০ ঢাকা

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ