ইউকে শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
হেডলাইন

আমার দেখা জেদ্দা নগরী

আমার দেখা জেদ্দা নগরী

আমার দেখা জেদ্দা নগরীআহবাব চৌধুরী খোকন :  জেদ্দা মক্কা প্রদেশের অন্তর্গত সৌদীআরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং ব্যস্ততম বানিজ্যিক কেন্দ্র ।সম্প্রতি ভ্রমন করার সুযোগ হয়েছিল প্রচুর বাংলাদেশী লোক অধ্যুষিত লোহিত সাগর তীরের এই নগরীটি।কাঁছ থেকে দেখার সুযোগ হল এখানকার সমস্যা, সম্ভাবনা ও নগরীতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবন যাপন। আমরা যখন জেদ্দায় পৌছি তখন ঘড়িতে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা। সাথে আমার সহধর্মিনি মিসেস সৈয়দা রোহেনা আহবাব, একমাত্র ছেলে রাইয়ান মোজাহিদ এবং আমার বন্ধু রিয়াদের জনপ্রিয় কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট এম শাহাবুদ্দীন খালেদ। হোটেলের লবিতে আমাদের জন্য পূর্ব থেকে অপেক্ষা করছিলেন জেদ্দায় বসবাসরত আমার আরেক বন্ধু বিশিষ্ট সমাজকর্মী শাহিন আহমদ এবং মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ।শাহিন আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু ।

দেশের বাড়ী ফেঞ্চুগঞ্জের পুরানবাজারে। আমরা এক সাথে স্কুলে এবং কলেজে পড়েছি। এখন দুজনই প্রবাসী। আমি নিউইয়র্কে আর সে জেদ্দায়।শাহীন গত ৩০ বছর যাবৎ এখানকার একটি বৃহত্তম গ্লাস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আছে।চসৌদীআরবে পৌছার পর থেকে সর্বক্ষন আমার খোঁজ খবর নিযেছে। তার এই আন্তরিকতা কখনো ভুলে যাওয়ার নয় ।গতরাত আমাদেরকে সময় দিযেছে মক্কায় আজ আবার কাজ থেকে ছুটি নিয়ে সময় দিচ্ছে জেদ্দায় ।তার এই অকৃত্রিম আতিথিয়তা আমাকে চির কৃতজ্ঞায় আবদ্ধ করেছে ।

জেদ্দার কিছু এলাকা ঘুরে মনে হল আমাদের দেশের সাথে যতেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছ । কিছু কিছু এলাকায় দেখলাম আমাদের দেশী ভাইয়েরা সাইড ওয়াকের উপর নিয়ে বসেছেন রকমারী পণ্যের ব্যবসা। কেউ জুতা, সেন্ডেল, কেউ বাচ্চাদের খেলনা ,আবার কেউবা পোশাক পরিচ্ছেদ। আবার কিছু এলাকায় দেখলাম ছোট ছোট বচ্চারা ও দিব্যি ফেরিওয়ালার কাজ করছে। যে বয়সে তাদের হাতে বই খাতা থাকার কথা ।সেই বয়সে নেমে পড়েছে কাজে। খোঁজ নিয়ে জানলাম ।এরা সবাই ইয়েমেনি ।মা বাবার সাথে তারাও এভাবে কাজ করে। সৌদীআরবের এক জেদ্দা প্রদেশে বসবাস করেন ৮ লক্ষ বাংলাদেশী। যাদের কঠোর পরিশ্রম এবং পাঠানো অর্থের কারণে দেশে ভাগ্যের চাকা ঘুরছে। বেড়েছে আমাদের জাতীয় মাথাপিছু আয়। অথচ কঠোর পরিশ্রম করেও বেশীর ভাগ প্রবাসী এখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বলাদ সিটেতেই দুই লক্ষ বাংলাদেশী বসবাস করেন। এখানকার কয়েকটি মার্কেটে ঘুরে দেখা গেল এখানে কর্মরত শতকরা ৯০ শতাংশই বাংলাদেশী। বলাদে অবস্থিত সুরা মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে আমরা চা খেতে গেলাম পাশের মার্কেটে। পরিচয় হল এক প্রবাসীর সাথে। নাম সেলিম ।দেশের বাড়ী কুমিল্লার চৌদ্দ গ্রামে ।এখানে একটি ছোট চা স্টলে চা বিক্রি করেন ।

তার হাতের তৈরী চা পান করতে করতে জানার চেষ্টা করলাম এখানকার নানুষের জীবন যাপন। চৌদ্দ বছর যাবৎ এখানে আছেন তিনি। বউ, বাচ্চা দেশে রেখে এসেছেন। প্রতি দুই তিন বছর পর পর দেশে বেড়াতে যান। আরেক ভদ্র লোকের সাথে দেখা হল হোটেলের সামনে ভোর ৭টায়। পেশায় ক্লিনার। হেঁটে হেঁটে রাস্তা পরিকার করছেন। নাম তারেক মিয়া। দেশের বাড়ী নারায়নগঞ্জ। এক বছর হয় এখানে এসেছেন। এভাবে সারা দিন হেঁটে হেঁটে প্রচন্ড গরমের মধ্যে কাজ করেন তিনি। অথচ এত অমানুষিক পরিশ্রম করে যে অর্থ পান তাও খুব সন্তোষ জনক নয়। রাতে বালদ থেকে গুলাইল যাওয়ার সময় দেখা হল অন্য এক ভদ্রলোকের সাথে। নাম রফিক। দেশের বাড়ী মায়মনসিংহ। পেশায় টেস্কি চালক। বললেন গত মাসে পনের হাজার রিয়াল ব্যয করে আকামা রিনিউ করেছেন।

১৫/১৬ ঘন্টা কাজ করে যে টাকা উপার্জন করেন তাতে খুব একটা সেইভ করতে পারেন না। আকামা হচ্ছে সৌদি আরবের পরিচয় পত্র। বৈধ ভাবে থাকলে হলে আকামা প্রযোজন। আকামা ছাড়া কেউ চাকুরী কিংবা বৈধ কাজ করতে পারবেন না। আকামা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দেওয়া হয় ।মেয়াদ চলে গেলে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা পরিশোধ করে রিনিউ করতে হয় জায়নামাজ কিনতে গিয়ে কথা হল এক সিলেটি ব্যবসায়ীর সাথে। বললেন সৌদির আগের সেই সুখ আর নেই। এই ব্যবসা এক সময় আরো বড় ছিল। সরকার নতুন নিয়ম করেছে সৌদি লোক ছাড়া কেহ ব্যবসা করতে পারবেন না। নতুন আইন অনুযায়ী যে কোন ব্যবসায় শতকরা ৭০ ভাগ আরবীয় লোককে নিয়োগ দিতে হবে। ফলে মাল কমিযে এই দোকান এখন তিনি একাই চালাচ্ছেন একজন সৌদি লোককে চাকুরী দিয়ছেন। সে বিকাল ৫ঠা থেকে ১০ঠা পর্যন্ত এসে বসে দোকানে। এই জন্য তাকে বেতন দিতে হয় মাসিক চার হাজার সৌদি রিয়াল। কোন রকম আছেন। আরেক জন পেলাম বললেন বাধ্য হয়ে উনাকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সৌদি কর্মচারীকে বেতন দিয়ে যে টাকা বাচাতে পারেন তা দিয়ে দোকান ভাড়া দেওয়াও কষ্টকর ।

বালদে ট্রেন সদৃশ্য একটি বিশাল মার্কেট রয়েছে। এই মার্কেটের ফ্রন্টের দোকানটি দেখতে হুবুহু যেন একটি ট্রেনের ইঞ্জিন। কথিত আছে যে এক সময় এই এলাকা দিযে ট্রেন চলাচল করত। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে এই ট্রেন মার্কেট। এই ইঞ্জিনকে ঘিরে দেখলাম প্রচুর লোকজনের জটলা ।দিন-রাত এখানে নাকি এভাবে মানুষের আড্ডা লেগে থাকে। শাহিন জানালো বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার রাত এই এলাকা বাংলাদেশী মানুষের পদভারে এটোতা লোকারণ্য থাকে যে তখন এই এলাকায় মানুষ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেলা করতে পারে না। সারা সপ্তাহ কাজ করে বন্ধের দিন বাংলাদেশীরা এখানে এসে গভীর রাত অবদি আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। জেদ্দা শহর লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাত এখানকার সাগর পাড় থাকে মানুষে মানুষে লোকারণ্য।

অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে চলে যায় সাগর পাড়ে।হই হুল্লুর করে কাঠান সারা রাত ।আমরা ঘুরতে ঘুরতে যখন সাগর পাড়ে পা রাখলাম তখন বুধবার রাত । কিন্তু এই সময়ও লক্ষ্য করলাম কিছু মানুষ এখানে রক্ষিত বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছে। বাচ্চারা সাগর তীরে দৌড়া দৌড়ি করছে আর বড়রা কেউ আড্ডা দিচ্ছে কেউ গোল হয়ে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে। রাতে এখানকার সাগর পাড়ের দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ। সাগরের তীরে একটি ফোয়ারা রয়েছে। এই ফোয়ারার নাম জেদ্দা ফোয়ারা ।রাত্রি কালে বিভিন্ন রংয়ের আলো যখন পড়ে এই ফোয়ারার পানিতে তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয় ।

শাহিন আমাদেরকে রাতের খাবার খাওয়াতে নিয়ে গেল একটি পাকিস্থানি রেষ্টেরেন্ট। সৌদীআরবের খাবারের কোন তুলনা হয় না। যেমন সুস্বাদু তেমনি সস্তা। এবার জেদ্দায় গিয়ে প্রিয় যে সকল মানুষের সাথে দেখা হয়েছে মিজান চৌধুরী তাদের মধ্যে একজন। মিজান স্বপরিবারে থাকেন জেদ্দার ফয়সালিয়ায়। বালদ থেকে এই সিটির দুরত্ব গাড়ীতে মিনিট ত্রিশেকের ড্রাইভ। মিজান আমার গিন্নির ভাতিজা। দেশের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং। খুব আন্তরিক মানুষ। আমরা জেদ্দা এসেছি শুনে মিজান বার বার ফোনে যোগাযোগ করেছে । আমাদেরকে তার বাসায় নিয়ে রাখার জন্য জোর দিয়েছে। তার চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য যেতে তার বাসায়।

সেখানে ঘন্টা খানেক বসে আবার গুলাইল হয়ে ফিরে এলাম বালদে আমাদের হোটেলে। গুলাইল সিটি জেদ্দার আরেকটি বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা ।এই এলাকায় প্রচুর বাংলাদেশী বসবাস করে। গুলাইলে বসবাস করেন আমার এক প্রিয় বড়ভাই শাহ ফরহাদ হোসেন। ফরহাদ ভাই সংস্কৃতিমনা মানুষ। ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘের প্রাক্তন কর্মকর্তা। দেশের বাড়ী ফেঞ্চুগঞ্জের রাজনপুর গ্রামে। অনেক দিন থেকে জেদ্দায় আছেন। কথা দিয়ে ছিলাম রাতে উনার বাসায় যাব। কিন্ত সময়ের অভাবে কথা রাখতে পারিনি বলে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করলাম। পরের দিন ভোর ৭ঠায় হোটেলে এলেন জেদ্দার তরুন ব্যবসায়ী মিনহাজ আহমদ। মিনহাজের বাড়ী ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ায়। এক সময় জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। এখন স্বপরিবারে জেদ্দায় থাকে। এখানে শাজাজাল সুপার মার্কেট নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্টানের স্বত্তাধিকারী।। একই ঘরের নীচে তার ব্যবসা এবং উপরে থাকার ঘর। আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল তার ব্যবসা প্রতিষ্টান। মিনহাজ ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সর্বশেষ তাকে দেখেছিলাম।

এখন সে জেদ্দায় ব্যাবসায়ী। আমি জেদ্দায় এসেছি শুনে সে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে তাতে আমি অভিভূত। মিনহাজ রাতে আমাকে ফোন করে বেকফ্রাষ্টের দাওয়াত দিয়ে ছিল। বলেছিল সে সকাল ৭টায় হোটেলে আসবে। আমাকে নিয়ে একটু সময়ের জন্য হলেও বসতে চায়। হোটেলে ব্রেকফাস্ট ব্যাফের ব্যবস্থা রয়েছে আমি বাহিরে গেলে হোটেলের ব্রেকফাস্টকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু মিনহাজের আন্তরিক আবদারে না করতে পারলাম না। মিনহাজ সকাল ৭টায় এসে আমাদেরকে জেদ্দার একটি আরেবিয়ান রেষ্টেরেন্টে নিয়ে গেলেন। রেষ্টেরেন্টে নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্প চলছিল। দেশে এবং প্রবাসের অনেক গল্প এবং স্মৃতি রোমাঞ্চে কেঠে গেল ঘন্টাখানেক সময়। স্নেহাস্পদ মিনহাজ প্রদত্ত ব্রকফাষ্ট শেষে আমরা চলে এলাম জেদ্দা আব্দুল আজিজ এয়ারপোর্টে। এখান থেকে সকাল ১০ টার ফ্লাইটে রিয়াদের উদ্দেশ্যে ত্যাগ করলাম জেদ্দা। জেদ্দায় এই স্বল্পকালীন সফরকালে যারা আমাকে সময় দিয়েছেন। দেখিয়েছেন আন্তরিক আতিথিয়তা বিশেষ করে বন্ধুবর শাহিন আহমদ, ছোটভাই মিনহাজ ,মিজান, ফরহাদভাই ও নাসিরভাইসহ সকলকে জানাচ্ছি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ।

লেখক: সংগঠক ও কলাম লেখক, নিউইয়র্ক ।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com