
শামসাদ হুসাম: ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল,/ রেললাইন বহে সমান্তরাল।’ কবি-সাহিত্যিকেরা প্রেমের উপমা টানতে গিয়ে রেললাইনের পাশাপাশি চলাকে এভাবেই সামনে নিয়ে এসেছেন। এ এক চিরবিরহের উপমা। তাঁদের মতে লাইন দুটি পাশাপাশি চললেও কোনো দিন এক হতে পারবে না; এক হতে গেলেই দুর্ঘটনা নিশ্চিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের কিছু কিছু দুর্ঘটনাকে সামনে রেখে নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা এ গানের লাইন দুটির কাছেই যেন ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের।
রেললাইন নিয়ে গুগল সার্চ দিতেই এমন একটা ছবি ক্যাপশনসহ সামনে এল। চোখ সরিয়ে নেওয়ার উপায় রইল না আর। বিশ্ব ইজতেমায় যোগদানরত মুসল্লিদের বহনকারী একটা ট্রেনের ছবি সেটি, যেখানে ট্রেনটির কোনো শারীরিক অবয়ব চোখে পড়ে না। কেবল পিঁপড়ার মতো মানুষের উপস্থিতি। ছবিটির নিচে লেখা, ‘মোস্ট ক্রাউডেড ট্রেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’ অবশ্য এই চিত্র কেবল ইজতেমার সময়ে দেখা যায় তা নয়’ দুই ঈদের সময়েও এমন ছবি দেখা যায়। ওই সময়গুলাতে ঘরমুখী ও ঘরফেরত মানুষের বাড়তি চাপ নিয়ে ট্রেনগুলা চলাচল করে পুরো দেশে। আর যাত্রীরাও টের পান কতটা টেনশনে সময় পার করতে হয় একেকটা পরিবারের। এই যাত্রীরা কিন্তু বিনা ভাড়ায় চলাচল করে না। স্ট্যান্ডিং টিকিটে যাতায়াত করে ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী। তারপরও রেলওয়ে বিভাগ লোকসানের বৃত্ত ভাঙতে পারছে না।
সে যাই হোক, রেল নিয়ে লিখতে বসা, সম্প্রতি বাংলাদেশে হওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে উপলক্ষ করে। যদিও প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসন থেকে যখন কোনো দুর্ঘটনার পরপর উচ্চারিত হয়— ‘শীত এলে বিদেশেও যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানে আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কী আছে?’ তখন সাধারণ জনগণের মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, তা সহজেই অনুমেয়। শীত এলে বিদেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে—এটা সত্য। বিদেশ মানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ যেসব দেশের পথ-ঘাট শীতের সময় বরফে ঢেকে যায়, পিচ্ছিল হয়ে পড়ে রেলের সমান্তরাল লাইনগুলা তখন সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে তা অবশ্য মাঝেমধ্যে। কিন্তু সেই সব দুর্ঘটনার সঙ্গে দেশের ভেতরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তুলনা বিচার কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
১১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে কসবা উপজেলায় তূর্ণা নিশীথা ও উপবন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে ১৬ জন যাত্রী মারা গেল। আহত হলো শতাধিক লোক। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহাত কম নয়। বলা হচ্ছে, এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা। অবশ্য এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকতেই পারে। কারণ, এর চেয়ে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে অতীতে। তবে এই দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে চালকের গাফিলতির মতো একটা বিষয়। এমনিতে ট্রেন অটো ব্রেক সিস্টেমে চলে। নিয়ম হচ্ছে ব্রেকের ওপর চালককে পা চাপা দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, দুর্ঘটনার রাতে চালক ও তাঁর সহকারী দুজনই অটো সিস্টেমের ওপর ইট চাপা দিয়ে গভীর ঘুমে ছিলেন। ধারণা করা অনুচিত নয় যে, এভাবেই তাঁরা দায়িত্ব এড়িয়ে নিয়মিত রাত-যাপন করতেন। দুর্ঘটনাটা ঘটায় বিষয়টা সামনে এসেছে। না হলে এভাবে দায়িত্ব পালনে অবহেলা তাঁরা করেই যেতেন। শুধু তাঁদের অবহেলার কারণে কত জনের জীবন ওলট-পালট হয়ে গেল।
দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই যে এতগুলো পরিবারের ক্ষতি, তার দায়-শোধ করবে কে? হ্যাঁ, দায়-শোধ করা হচ্ছে। চালকসহ সহকারী দুজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু হবে কিনা তা জানাটা সম্ভব নয় এখনই। অতএব আপাতত আমাদের ‘শীতে দুর্ঘটনা হলে’ অবাক না হয়েই থাকতে হবে। রেলওয়ে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে সরকার থেকে যা বলা হবে, তা-ই মানা হবে এবং তা-ই আমাদের মেনে নিতে হবে। তারপরও কিছু কিছু কথা মেনে নিতে কষ্ট হয়। এই যেমন লোকসানের বিবরণে সব সময় রেল বিভাগের নামটি পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে রেল বিভাগের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই হিসাব যখন সামনে আসে, তখন তা সাধারণের কাছে আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না। এক সময় রেলের ‘কালো বিড়াল’ মারা নিয়ে দেশে কত কাণ্ডই না ঘটল। খুব বেশি দিন আগের ঘটনা তো নয়।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে—‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’। এই বাক্যটি যে শুধু রেলওয়ে বিভাগের জন্যই প্রযোজ্য, তা কিন্তু নয়। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কাহিনি থেকে শুরু করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি কিংবা ক্যাসিনো কাণ্ড হয়ে এই হালের পেঁয়াজ সংকটের পেছনে যদি কোনো জুতসই কারণ খুঁজতে হয়, তবে তা হচ্ছে জবাবদিহি না থাকা। এ কারণে দেশজুড়ে রেললাইন সমান্তরালভাবে চললেও দুর্ঘটনার হার কমানো যাচ্ছে না কিছুতেই। সারা দেশে শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে গোটা রেলপথ। সেতুগুলোর অবস্থা আরও মারাত্মক। ফলে বিষয়টি ক্রমাগতই আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দুর্ঘটনার পেছনে যে নাশকতামূলক কাজও থাকে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। যেমন ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে ভেড়ামারার কাছে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে গেলে মারা যান ২৫ জন যাত্রী। ঘটনাটি ঘটিয়েছিল সর্বহারা পার্টির লোকেরা। এর আগে ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে একটি সেতু ভেঙে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে মারা যান ৬০ জন। এর চেয়েও বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে টঙ্গী রেল স্টেশনে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে ১৭০ জন মারা যায়। এখন পর্যন্ত এটিই এ অঞ্চলে হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা।
সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে রেল দুর্ঘটনার হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সিলেট অঞ্চলে চা বাগানের স্বার্থে ১৮৯১ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের গোড়া পত্তন হয়েছিল। এর একটি লাইন করিমগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে লাইনটি সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল ১৯১২ সালের দিকে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর নাম পরিবর্তন হয়েছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে। পরে ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে নামকরণ হলেও একাত্তরের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই রেল বিভাগটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে চলে আসায় তার নাম হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় এর সংস্কারও করতে হয় তুলনামূলক বেশি। বৃষ্টির সময় পাহাড়ি ঢল ও পাহাড় ধসে রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এ অঞ্চলের রেললাইন নিয়মিত সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এ সংস্কারকাজ করা হয় না। তার ওপর লাইনে পর্যাপ্ত পাথর থাকে না অনেক সময়। রয়েছে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব। এসব কারণে শুধু ১৯৯৫ সালেই সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে একুশটির মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে সে সময় ১৬৭ ঘণ্টা রেলযোগাযোগ বন্ধ ছিল। চলতি বছর এই রুটে এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে যে, অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশের আর কোনো অঞ্চলে এত দুর্ঘটনা কখনোই ঘটেনি। চলতি বছরের ২৩ জুন কুলাউড়ায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের চারটি বগি খালে পড়ে গেলে মারা গিয়েছিলেন ছয়জন। অবস্থা এখন দিকে যাচ্ছে যে, মৃত্যুফাঁদ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সড়কপথের জায়গাটি রেলপথই দখলে নেয় কিনা, সে সংশয় দেখা দিচ্ছে। এ সংশয় দূর করতে হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
শামসাদ হুসাম
উপদেষ্টা সম্পাদক
ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম