ইউকে রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

স্মরণ : মায়ের বিকল্প এক মা


শামসাদ হুসাম: গত অক্টোবরে তাঁর মৃত্যু দিবস ছিল। তারিখ মনে নাই। তবে প্রথম দিকেই হবে। তিনি বিলকিস জায়গীরদার। সিলেটের সমাজসেবার অঙ্গনে এক পরিচিত মুখ। ছোট-বড় সবার কাছেই ছিলেন খালাম্মা মাতৃসমা এক নারী। ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে দীর্ঘ আর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন এই পৃথিবী থেকে। মৃত্যু প্রতিটি মানুষের কাছে বেদনার। কিছু মৃত্যু পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজকে পর্যন্ত আঘাত করে। সৃষ্টি করে শূন্যতার এক সীমাহীন অন্ধকার। বিলকিস খালাম্মার বিদায় তাঁর গুণগ্রাহীদের জন্য তেমনি শূন্যতার হাহাকার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
আসলে এক শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হিসেবে সমাজের অনগ্রসর নারী সমাজের প্রতি ছিলেন দায়বদ্ধ। ব্রিটিশ ভারতের শাসন আমলের একপর্যায়ে ১৭৬৫ সালে সিলেট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। প্রথমদিকে শাসকেরা এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করেনি। বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিস্তারে খুব একটা কিছু করেনি। অধিকন্তু সিলেটের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ থাকলেও সুযোগের অভাব ছিল।
ব্রিটিশ সরকার নানা ক্লাসের প্রবর্তন করেছিল। সিলেটের কয়েকজন প্রগতিশীল নারীকে ওই সব জেনানা ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের বলা হতো গভর্নেস। এসব গভর্নেসরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের নানামুখী শিক্ষাদানের কাজ করতেন। এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম পাওয়া যায়। যারা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা হলেন সরজুবালা বর্মণ, ইন্দু বালা চৌধুরী ও মিসেস ব্যানার্জি। এ তিনজনের মধ্যে একজনের উত্তরসূরি ছিলেন বিলকিস জায়গীরদার। স্বভাবতই তাঁর মায়ের উন্নত চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। আর সে কারণেই তিনি এতটাই অগ্রসর চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন যে সবার কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন।
রাজনীতি থেকে সমাজসেবা, সব অঙ্গনেই সমান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে গেছেন বিলকিস জায়গীরদার। তিনি সিলেটের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং মেম্বার ছিলেন। রেডক্রসের দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এমনকি সিলেট পৌরসভার কমিশনার হিসেবে দীর্ঘ ১৮ বছরের মতো দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। তাঁর অন্যান্য গুণাবলির ভেতরে অন্যতম ছিল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সিলেটের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে নির্যাতিত নারীদের উদ্ধার করে তাদের পুনর্বাসনের কাজ করা মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন বিলকিস জায়গীরদার।
এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল আমার। দূর থেকেই দেখতাম। খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না যদিও। কিন্তু সিলেটের আর একজন সমাজসেবী নারী ছায়া আহমেদ। তিনি ১৯৮৪ সালে সিলেট সুরমা লায়ন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠার সুযোগে সিলেটের প্রগতিশীল নারীদের এক কাতারে এনে জড়ো করেছিলেন। লায়ন্স ক্লাব একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন। ইতিপূর্বে এই সংগঠনের দুটি শাখা ছিল। একটি পুরুষদের এবং একটি নারীদের। পরবর্তীতে অবশ্য দুটি ক্লাব এক সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ নারী-পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের দেয়ালটা তুলে দেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্তটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছিল।
ছায়া আহমেদ এক সময় সিলেট লায়ন্স লায়ন্স ক্লাব থেকে বের হয়ে সিলেট সুরমা লায়ন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ওই সময় একদল প্রগতিশীল নারী মাঠে অবস্থান করছেন। তাঁদের পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক ছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রথম পর্যায়ের সংসদ সদস্য আবেদা চৌধুরী ও মুক্তিযোদ্ধা ইসমত আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ফাতেমা চৌধুরী পারু। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দুই বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া সুরাইয়া রাজা চৌধুরী ও হোসনে আরা আহমেদ প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করে সিলেটের শিশু-কিশোরদের আত্ম উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন খালেদা জিয়ার শাসনামলের সংসদ সদস্য আবেদা চৌধুরী বেদানা, বেগম আজিমা সামাদ চৌধুরী, নাজনীন হোসেন, লাভলী চৌধুরী, বেগম রওশন আজিজ, জোসনা তাহের, মিনা রাজা চৌধুরী, নীলা চৌধুরী, হালিমা চৌধুরী, নার্গিস ইসলাম, লিলি আহমেদ এবং শিরিন ওসমানসহ আরও কয়েকজন।
ছায়া আহমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুরমা লায়ন্স ক্লাবের জন্ম হলো ১৯৮৪ সালে। কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে বিলকিস জায়গীরদারের নাম ঘোষণা করলেন। এবার বিলকিস জায়গীরদার তাঁর সেক্রেটারি নির্বাচন করবেন। লেখালেখি করার কারণে সিলেটে তখন আমার একটা পরিচয় ছিল। তাই কারও কোনো আপত্তি না শুনে তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেই থেকে এক সঙ্গে পথ চলা শুরু হলো আমাদের। তাঁর নিজের তিন কন্যা সন্তান ছিলেন। কিন্তু অনেকের কাছে আমাকেও তাঁর মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আক্ষরিক অর্থেই আমি তাঁর মেয়ে হয়ে উঠেছিলাম।
লায়ন্স ক্লাব একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন। এর প্রধান কার্যালয় আমেরিকায়। বাংলাদেশ যত শাখা আছে সেসবের মূল নেতৃত্ব ঢাকায়। ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ এর অধীনে পরিচালিত ওই সব শাখার কাজ ছিল সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাওয়া। বিলকিস জায়গীরদার ও ছায়া আহমেদকে নিয়ে আমরা সিভিল সার্জনের অফিস থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা করতাম। এ ছাড়া সে সময় ডাক্তারদের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে ওষুধ কোম্পানির দেওয়া স্যাম্পল ওষুধ সংগ্রহ করে ঘরে ঘরে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমরা। মাসিক সেবা কার্যক্রমের বিবরণ জানিয়ে সুরমা প্রবাহ শিরোনামের মাসিক বুলেটিন প্রকাশ করতাম। এ ছাড়া মাসিক সবগুলো সেবা কার্যক্রম প্রমাণ দলিল, নমুনা কপি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাঠাতে হতো। বছরের শেষের দিকে হিসাব-নিকাশ শেষে নির্ধারিত হতো ১ থেকে ১০ এর ভেতরে থাকা ক্লাবের নাম।
লায়ন্স ক্লাবের আরও একটি সংগঠন ছিল লিও ক্লাব নামে। তরুণদের সংগঠন ছিল সেটা। একবার একটা লিও ক্লাব তাদের একটা প্রজেক্টের জন্য একটা দেয়াল ঘড়ি আমাদের কাছে চেয়ে বসল। আমরা ৫০০ টাকা দিয়ে ঘড়িটা কিনে দিলাম। বিনিময়ে আমাদের হাতে তারা পাঁচটা ফরম ধরিয়ে দিল। বিলকিস জায়গীরদার আমার হাত চেপে ধরলেন। বললেন, খবরদার কোনো অনৈতিক কাজ করবে না তুমি।
সুরমা লায়ন্স ক্লাব প্রথম ১০-এর ভেতর থাকতে পারল না। সে জন্য বিলকিস জায়গীরদারের কোনো দুঃখবোধ ছিল না। বছর শেষে দায়িত্বটা চলে গেল অন্য কমিটির কাছে। কিন্তু আমি তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকলাম।
৯৫ সালে দৈনিক বাংলায় কাজ করলাম এক বছর। ওই সময় আমি বিলকিস জায়গীরদারের ওপর একটা সচিত্র প্রতিবেদন করেছিলাম। খুশি হয়েছিলেন তিনি। পরে আস্তে আস্তে বয়সের কাছে নতজানু হতে থাকলেন তিনি। অনেকটা বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে লাগলেন। বিষয়টা উত্তর প্রজন্মের নারীদের কাছে কষ্টের কারণ হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, বেঁচে থাকতেই বিলকিস জায়গীরদারকে নিয়ে বড় অনুষ্ঠান করবেন সবাই। আমি কিন্তু সে অনুষ্ঠানে থাকতে পারলাম না। ৯৭ সালের মার্চ মাসে অভিবাসন নিয়ে আমেরিকা আসতে হবে। বিলকিস জায়গীরদারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা অগ্রজ ও সাহিত্যিক লাভলী চৌধুরী হাতে দিয়ে চলে এলাম দেশ ছেড়ে। পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময় কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে দেশে আবার ফিরে গেলাম।

জার্নির ধকলে কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম। তাই বিলকিস জায়গীরদারকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এরই মাঝে একদিন খবর এল তিনি আর নেই। প্রচণ্ড অপরাধবোধে আক্রান্ত হলাম আমি। বারবার মনে হতে লাগল এতটা কেয়ারলেস না হলেও পারতাম। বেঁচে থাকতে একটা বার দেখতে গেলাম না। বেঁচে থাকতে আমার কাছে তিনি মায়ের বিকল্প এক মা হয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন শেষ দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মনে হলো একবার তাঁর হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখি। কত দিন এই দুই হাত দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে আদর করেছেন তিনি আমাকে। কিন্তু কিছুই করা হলো না।
চার দিন পর আম্বরখানার বাসায় কুলখানিতে গেলাম। বিলকিস জায়গীরদারের ছেলে মুস্তাকের বউ আমার হাত ধরে বসে থাকলেন। কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘আপা আপনাকে মা এত মায়া করতেন, উনি মারা যাওয়ার আগে আপনি দেশে ফেরত এসেছেন শুনে কেবল মনে হয়েছিল আপনাকে দেখার জন্যই বাকি কটা দিন বেঁচে ছিলেন মা। সেই আপনি তাঁকে দেখতে এলেন না!’
এর কী উত্তর দেব আমি? জবাব আসলে কিছুই ছিল না দেওয়ার। ডুকরে কেঁদে ওঠা ছাড়া। আজ এই স্মৃতিটাই আমাকে কষ্ট দেয় খুব। অক্টোবর মাস চলে গেল। তাঁর বিদায় নেওয়ার সেই সময়টা স্মৃতির দরজায় খুব নাড়া দিয়ে গেল।

শামসাদ হুসাম
উপদেষ্টা সম্পাদক
ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ