
শামসাদ হুসাম:
পয়লা নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় অগ্রজ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমানের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম, ‘দিন শেষে কেউ হিরো’। তিনি একজন ভালো কলামিস্ট। মাঝখানে নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেকটাই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরীর কারণে ফিরে এসেছেন আবার সংবাদপত্রের জগতে। সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত এ ধরনের মানুষদের যখন ওই মাধ্যম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় কিংবা যেকোনো কারণেই হোক সরে যেতে হয়, তখন তাদের কাছে বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়ে। বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া মানুষের মতো উপমার বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠতে হয় কখনো কখনো। সে কারণে মাহবুবুর রহমানের লেখালেখির জগতে ফেরত আসাকে স্বাগত না জানিয়ে পারা যায় না।
মাহবুব সাহেবের অনেক লেখায় অতীত ফিরে আসে। সেখানে মাঝেমধ্যে আমাদের কথাও থাকে টুকটাক। অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে। গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এই কথাটি বলতে ইচ্ছে করে—‘তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে…।’ আজকের এই লেখাতে অবশ্য তেমন কোনো আবেদন নেই। বরং অন্য একটি দিক রয়েছে।
মাহবুবুর রহমান তাঁর লেখায় আমাদের এক সময়ের সহকর্মী অপূর্ব শর্মাকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। এটা স্বীকার করতেই হবে সিলেটে সমসাময়িক সংবাদপত্রের জগতে অপূর্ব শর্মা এক উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখালেখির কল্যাণেই এটা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্যতম লেখক ও গবেষক কানাডাপ্রবাসী তাজুল মোহাম্মদের পরই অপূর্ব শর্মার নাম উচ্চারিত হয়। তাঁর অনেকগুলো গবেষণাধর্মী মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে।
এক জায়গায় মাহবুব সাহেব লিখেছেন, ১৯৮৯ সালে আমেরিকায় আসার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক যুগভেরীতে কাজ করেছি আমি। ফাহমিদা রশীদ চৌধুরী আজিজ আহমদ সেলিম ও তাপস দাস পুরকায়স্থকে নিয়ে পত্রিকাটি এগিয়ে নিয়ে যান। এরপর হাল ধরেন অপূর্ব শর্মা। খুব বিনয়ের সঙ্গে আমার জানতে ইচ্ছে করে, ওই সময় আমি কোথায় ছিলাম? আমি কি কোনো সময়ে তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলাম? প্রথম আলোতে বেশ কয়েক সংখ্যা আগে তিনি আমাকে নিয়ে লিখলেন, শামসাদ হুসাম যুগভেরীতে চাকরিতে যোগদান করলেন। মজার ব্যাপার হলো, সাহিত্যের পাতা দেখার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই পড়ল। এখানেও সেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি! অর্থাৎ, শামসাদ কখনো সাংবাদিক ছিলেন না।
আমি ১৯৮৩ সালে যখন পত্রিকায় যোগ দিলাম, তখন সাহিত্যের পাতা দেখতেন হামিদ মোহাম্মদ। পরে আমার একই সময়ে যোগ দেওয়া সহকর্মী আজিজ আহমদ সেলিম সাহিত্যে পাতার দায়িত্ব পান। কারণ, হামিদ ভাই লন্ডন চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য হামিদ ভাই, মনি ভাই ও তুষার দাসহ আরও কয়েকজন মিলে প্রগতিশীল কবিতার সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন; নাম ছিল ‘শিখর’। ওই সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার সুযোগ আমারও হয়েছিল। সে অবশ্য ভিন্ন কথা। আশির দশকের সেই সময়ে পত্রিকায় কাজ করতেন টিপু মজুমদার; খেলার পাতা দেখতেন। তিনি ও আব্দুল মালিক জাকা ভাই পত্রিকার নিউজ সেকশনে যোগ দেন। এ ছাড়া হোসনেআরা হেনা পত্রিকার বিভিন্ন পাতায় ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতেন। ওই সময়ে কবি দিলওয়ারকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের আসর ‘শাপলার মেলা’র আসর বসত। একপর্যায়ে সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী চিরকুট দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘যুগভেরী একটি সংবাদপত্র। এটি সাহিত্য পত্রিকা নয়।’ চিরকুটের কথা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাহেব অনেকবার তাঁর লেখায় স্মরণ করেছেন। আশির দশকের শেষের দিকে তাপস দাস পুরকায়স্থ নিউজ সেকশনে যোগ দিয়েছেন। অপূর্ব শর্মা অবশ্য আরও পরে যোগ দেন।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আশির দশকের শুরুর সময়টাতে দেশে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। ওই সময়ে রাজশাহীতে ইকবাল নামের এক চিকিৎসক থাকতেন। তিনি তাঁর ঘুমন্ত স্ত্রী সালেহার গলা ব্লেড দিয়ে কেটে হত্যা করেন। অবশ্য এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ইকবালের সঙ্গে তাঁর বাসার নারী গৃহকর্মীর অনৈতিক সম্পর্ক, যা তাঁর স্ত্রী সালেহা মানতে পারেননি। এরই পরিণতিতে স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হয় সালেহাকে। এ ঘটনায় রাজশাহীর কোর্টে একটি মামলা হয়, যার রায়ে ইকবালের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন বিচারক। এতটুকু পর্যন্ত যথেষ্ট ছিল। কারণ, এমন হত্যাকাণ্ড দেশে আগেও ঘটেছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল অন্যখানে। ইকবাল ছিলেন প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাই ওই খবর প্রকাশিত হওয়ামাত্র দেখা গেল, জাতীয় একটি সংবাদপত্রে সেই সময়ে দেশের প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে ৫২ জন রায়ের কার্যকারিতা বন্ধের আবেদন জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তাঁরা বলেন, ইকবাল যেহেতু একজন চিকিৎসক। সমাজে একজন চিকিৎসকের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে যেন মহামান্য আদালত ফাঁসির আদেশ মওকুফ করেন।
খবরটা পড়ার পর নিজের ভেতর প্রচণ্ড এক আলোড়ন ওঠে। কেবলই মনে হচ্ছিল যে, এ কোন সমাজে বসবাস আমাদের? যেখানে একজন মানুষ আরেকজনকে জবাই করে হত্যার পরও সমাজের প্রভাবশালী মানুষের সহানুভূতি লাভ করে। একজন খুনি পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের একজন হওয়ার কারণে এমনটা ঘটল। আমার বয়স তখন ২২ কি ২৩ বছর। অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে প্রথম একটি উপসম্পাদকীয় কলাম লিখে পত্রিকার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহবুব সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম, আমাকে একটু সুযোগ দিতে হবে। তিনিও তাঁর কথা রেখেছিলেন। তারপর থেকেই লেখালেখির শুরু। সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী তখনো জীবিত। একদিন দেখা করতে গেলে বললেন, ‘তাইলে তুমি টেবিলে কাজ করতে পার।’ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহোদয়ও রাজি। কিন্তু বললেন, আপনি পত্রিকায় কাজ করতে চাইলে একটা জায়গা আছে। তখন মহিলার পাতা ‘অঙ্গন প্রাঙ্গন’ বের হতো। সম্পাদনা করতেন বেগম ফাহমিদা রশিদ চৌধুরী; আমিনুর রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমাকে জানালেন বেগম সাহেবের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে। আপনি টেবিলে যোগ দিতে পারেন। একটা ধাক্কা খেলাম আবারও। কিন্তু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আপত্তি করব না। আপাতত মেনে নিয়েই যোগ দেব। একদিন নিশ্চয় কাজ দেখিয়ে সম্মান আদায় করব।
বিপত্তি বাধে রিকশা থেকে নেমে যখন অফিসের চৌকাঠে পা রাখি। সামনের ঘরে বসা বয়োবৃদ্ধ সার্কুলেশন ম্যানেজার চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘কী ভাগের সাঁওতালি-তান আবার গিয়াসনগর?’ অর্থাৎ পত্রিকায় চলে না ভালোমতো, তার আবার মহিলা পাতার সম্পাদক। দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করি। অবশ্য খুব একটা কাজ করতে হয় না মহিলা পাতায়। কারণ, বেগম চৌধুরী নিজেই সম্পাদনা করতেন পাতাটি। কিন্তু পত্রিকার অন্যান্য কাজ, অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই—সব কাজই করেছি আমি একসময়। এমনকি খালেদা জিয়ার জনসভা অনুষ্ঠিত হবে মাদ্রাসা মাঠে, সেই নিউজ কভার করা থেকে শুরু করে সিলেট সেনানিবাসের সেমিনার অ্যাটেন্ড করা-তাও করেছি তখন।
তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাহেব দেশে ছিলেন। তিনি ৮৯ সালের শেষের দিকে আমেরিকা আসেন। আমি তারপরও টিকে রইলাম আরও বহুদিন, বহু বছর। ১৯৯৫ সালে জাতীয় দৈনিক, ‘দৈনিক বাংলা’-এর সিলেট ব্যুরো অফিসে কাজ করলাম এক বছর। ১৯৯৭ সালে পাঁচ মাসের জন্য নিউইয়র্কে অবস্থানকালে মাহবুব সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ‘বাংলা পত্রিকা’-তে কাজ করলাম পুরো পাঁচ মাস। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই দেশে ফিরে আবারও যোগ দিলাম পত্রিকায়। তত দিনে পত্রিকাটি দৈনিক হয়ে গেছে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তখন আজিজ আহমদ সেলিম। বার্তা সম্পাদক তাপস দাস পুরকায়স্থ। আর সহকারী সম্পাদক আমি। ওই পত্রিকার টেবিলেই কেটে গেল আমার ২১ বছরের মতো সময়। এত দিন কি কেবল মহিলা পাতার সঙ্গেই কাজ করেছিলাম? আমার মূল্যায়ন না হওয়ার মূলে আমার নারী জনমই কি শুধু দায়ী? মাঝেমধ্যেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার ইচ্ছা জাগলেও নিজেকে সংযত করি। তারপরও বলতে ইচ্ছে করে, আমারও যে কিছু বলার ছিল।
শামসাদ হুসাম
উপদেষ্টা সম্পাদক
ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম