ইউকে সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

‘আমি মানুষের জন্য গান বাঁধি’ মনে পড়ে বাউল সম্রাট…

মান্না চৌধুরী: আমি মানুষের জন্য গান বাঁধি। মানুষ আমার গান গায়, গান শুনে। কে নকল করলো আর কে গানে আমার নাম নিলো না এসব নিয়ে আমি ভাবি না! মানুষ সবকিছুর উর্ধ্বে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এই কথাগুলো বলে যান বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম।তিনি বলেন আর আমাদের চোখ কপালে উঠে। বিস্ময়ের জগতে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবি এই ঘুনে ধরা সময়ে, বাণিজ্যের ভুবনে খাটি, নিরহংকার মানুষ তাহলে আছেন!শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বেড়ে যায় কিংবদন্তির প্রতি। বাউল সম্রাটের মৃত্যুদিনে এসে অনেক আগের সেই স্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া। টুকরো টুকরো ছবি হয়ে চোখে ভাসছে এক যুগ আগের স্মৃতি। ২০০৭ সাল। শাহ আব্দুল করিম তখন অসুস্থ। তাঁর জীবন গাড়ি আর চলে না। কালনীর তীরে শুয়ে বসেই কাটে দিন,রজনী। সবুজ সিলেট সম্পাদক মুজিবুর রহমান বাউলের ভীষন ভক্ত। তিনি আমাকে এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন শাহ আব্দুল করিমের সাক্ষাতকার নিয়ে আসতে। সঙ্গী হিসেবে পেলাম আমিনুল ইসলাম রোকন আর সবুজ সিলেটের শাবি প্রতিনিধি নাঈমকে। প্রায় তিন ঘন্টা যাত্রা শেষে আমাদের গাড়ী থামলো সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরশহরের খেয়া ঘাট এলাকায়। নৌকা আগে থেকেই রেডি করে রেখেছেন সবুজ সিলেটের দিরাই প্রতিনিধি। স্থল থেকে জলে আমাদের যাত্রা। যাত্রাপথে স্বপ্ন বুনি, বাউল সম্রাটের সাথে দেখা হওয়ার স্বপ্ন, কথা বলার স্বপ্ন। কালনীর তীর ঘেষা বাড়ীতে পৌছলে ঘোর কাটে, চলে এলাম তাহলে। ভাটি বাংলায় এই প্রথম আমি। নদী, নৌকা সবমিলিয়ে সুখের অনুভূতি। আবার ভয়ও কাজ করে। বাউল সম্রাটের মুখোমুখি হওয়া কি সহজ কথা? কি প্রশ্ন করবো, কিভাবে নিবেন তিনি, অসুস্থ শরীর নিয়ে কথা বলবেন তো? ভাবনার সাথে বাস্তবতার কি মিল। প্রায় এক ঘন্টা চলার পর আমাদের ইঞ্জিন নৌকা নোঙর করলো জীবন্ত কিংবদন্তির ঘাটে। বাউল পুত্র নূর জালাল আমাদের স্বাগত জানালেন। কুশল বিনিময় শেষে যা বললেন তাতে আমরা চরম হতাশ। বাবার শরীর, মন দুটোই ভালো নয়। তিনি কারো সাথে কথা বলতে চান না। এনটিভির সুপন রায় এসেছিলেন, ব্যর্থ হয়ে তিনিও ফিরে গেছেন! প্রায় পাঁচ ঘন্টা জার্নি শেষে ক্লান্ত আমার মুখ থেকে কথা বের হয় না হতাশায়। তবে আমিনুল ইসলাম রোকন যেন অন্য ধাতুতে গড়া কেউ! ক্লান্তি, হতাশার কোন ছাপ নেই! আমরা আজ ইন্টারভিউ নিয়েই সিলেট ফিরবো, রোকনের আত্মবিশ্বাসী উচ্চারন! সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম রোকনও তখন বাউলদের মতোই! হালকা শরীরের ওপর মাথাভর্তি লম্বা চুল। গান,অভিনয়,গল্পে যেকোন পরিবেশ জমিয়ে তুলতে পারেন সহজে। যেই কথা সেই কাজ। বাউলে বাউলে মিলে গেল! শাহ আব্দুল করিম লম্বা ঘুম শেষে জাগলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেখে আর পরিচয় পেয়ে অগ্নিমূর্তি! সিলেটি ভাষায় চললো অবিরত গালি! ভয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। রোকন কিন্তু বাউলের কাছেই পড়ে থাকলেন! লেগে থেকে আগুনকে পানি বানিয়ে ছাড়লেন সহকর্মী সাংবাদিক রোকন! শুরু হলো কথার মালা- জীবন, গান, স্ত্রী, সংসার, কালনী, গ্রাম, মানুষ কত কিছু! একের পর এক প্রশ্নে খুলে দেন স্মৃতির জানালা। কথা শুরু হলে আর থামে না। আশি বছরের করিম যেন ৪০ বছরের তেজোদীপ্ত কোন তরুণ! তবে সব ছাপিয়ে সেই কথাগুলোই এখনো কানে বাজে, তউ কিতা ওইছে! আমি মানুষর লাগি গান বান্ধি, মানুষে আমার গান গায়, গান হুনে। কে গান নখল করলো আর কে গানো আমার নাম লইল না ইতা লইয়া ছিন্তা করি না। মানুষে যে আনন্দ ফায় ওখানে ওউ আমার আনন্দ! মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধা বাউল সম্রাট। যে মানুষের জন্য আপনার জীবন উৎসর্গিত সেই মানুষের দোয়া, ভালোবাসায় পরজনমে সুখে,শান্তিতে থাকবেন আপনি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ