
তানভীর আহমদ: আজ থেকে প্রায় ১২/১৩ বছর আগের অভিজ্ঞতা। বৃকলেইনে টাউটিং নিয়ে রিপোর্ট করছিলাম। ট্যুরিস্ট বা কাস্টমারদের টানাটানি করে রেস্টুরেন্টে খেতে বাধ্য করাকেই এখানে টাউটিং হিসেবে গন্য করা হয়। কারী ক্যাপিটাল খ্যাত ব্রিক লেইন সম্পর্কে পর্যটকদের অভিযোগ, এখানকার স্থানীয় রেস্টুরেন্ট স্টাফরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাউটিং করেন, একারনে পর্যটকরা এখন আর ব্রিক লেইনে আসতে স্বস্তি বোধ করেন না। যদিও কারী ক্যাপিটাল ব্রিকলেইন এখন তার পূর্বের ঐহিত্য অনেকটাই হারিয়েছে। যাই হোক, সেই গল্প অন্যদিন বলবো। ২০০৭ সালের দিকের ঘটনা হবে, আমি আমার সহকর্মী ক্যামেরাপার্সন আলীম ভাই টাউটিং নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে অসাবধানতা বসত ক্যামেরায় ড্রাগ ডিলারদের ছবি ধারণ করে ফেলেছিলাম যারা টাউটিং এর আড়ালে মূলত ড্রাগ ডিলিং করতো ব্রিকলেইনে। কিছুক্ষণ পর আলিম ভাই আমাকে ফোন দিয়ে জানালো তাকে একটি রেস্টুরেন্টে আটকে রাখা হয়েছে, ব্রিক লেইনের বিভিন্ন প্রবেশ পথে ড্রাগ ডিলারদের সাঙ্গ পাঙ্গরা পাহাড়ায় বসেছে তারা আমাকেও ব্রিকলেইন থেকে বের হতে দেবে না। আমি আত্নরক্ষায় আমাদের আরেক বড় ভাই বাংলা মিররের সম্পাদক আবদুল করিম গনি ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট গিয়ে আশ্রয় নিলাম। পরে আমাদের চ্যানেল এসের প্রতিষ্ঠাতা জলিল ভাইকে ফোন করে ঘটনার বিস্তারিত জানানোর পর তিনি গ্যাং গ্রুপের লিডারকে নিশ্চিত করলেন আমাদের রিপোর্টিং এর বিষয় ড্রাগ ডিলিং নিয়ে নয়, তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে ফুটেজ ধারণ করা হয়েছে সেগুলো মুছে ফেলা হবে। আমি আর আলীম ভাই সেই যাত্রায় ছাড়া পেয়েছিলাম। তারপর কেটে গেছে এক যুগের বেশী সময়। বছর দু’য়েক আগে উইন্টারে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে অতিরিক্ত তুষারপাত নিয়ে রিপোর্টিং করতে গিয়ে একদল কিশোর এসে আমার সহকর্মী রেজাউল করিম মৃধার ক্যামেরার সামনে এক দলা বরফ ছুড়ে দিলো। মৃধা ভাই এই কান্ডের কারণ জানতে চাইলে কিশোররা মৃধা ভাইয়ের উপর চড়াও হয়েছিলো। আমি এগিয়ে আসতেই আমার গায়েও বরফ ছুড়ে মারতে থাকলো কিশোররা। আমি নিজকে সামলে নিলাম, এধরণের চ্যালেঞ্জকে নিজের প্রফেশনের অংশ ভেবেই কিশোরদের শান্ত করতে চাইলাম। তাদের থামানো গেলো না, ‘কুল্লু হারাম’ ‘ইটস হারাম’ এই সব বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের দিকে বরফ ছুড়তে থাকলো। এদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘ডু ইউ লাইক হাছিনা?’ এমন কমেন্ট শুনে বাংলাদেশের সংবাদ সম্পর্কেও এই তরুণরা সচেতণ বলে মনে হলো আমার। অনুমান করি বখাটে সেই কিশোরদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের বেশী হবে না। তাদের পায়ের গোরালী পর্যন্ত লম্বা আলখেল্লা আর মাথায় সাদা টুপি।তাদের প্রত্যেকের গায়ে একই ধরণের আলখেল্লার রঙ দেখে অনুমান করি ইষ্ট লন্ডন ভিত্তিক কোন একটি মাদ্রাসার ছাত্র হবে তারা, ক্লাশ শেষ করে এক সাথে পার্কে আড্ডা দিতে এসেছেছিলো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দেখে আমরা পুলিশে রিপোর্ট করতে বাধ্য হলাম।পুলিশকে ফোন করেছি দেখে বখাটেরা দৌড়ে পালালো।
গতকাল কাজ শেষ করে অফিসে ফিরছিলাম, আমাদের গাড়ীটি বেথনালগ্রীন পাতাল রেইল স্টেশনের সামনের সিগন্যালে সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমাদের গাড়ীর কাঁচ অর্ধেকটা নামানো। আমি আনমনে বাইরে তাকিয়ে রয়েছি। মনে মনে স্ক্রিপ্টের আউটলাইনটাই ভাবছিলাম, অফিসে ফিরে যেন স্টোরিটা যথা সময়ে ধরাতে পারি মাথায় সেই চিন্তা। আমাদের পাশেই একদল কিশোর আরেকটি গাড়ীতে আমাদের পাস করছিলো। তারা অনেকটা গায়ে পড়েই আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলো। …হোয়াট, হোয়াট, বলে চিৎকার করছিলো পাশের গাড়িটির কিশোররা। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, কোন জবাব দিলাম না। বাতি সবুজ হওয়ার সাথে আমার সহকর্মী গাড়ী সামনে আগাতে আগাতে পাশের গাড়ীতে থাকা কিশোরদের কাছে জানতে চাইলো, ‘হোটাটস হ্যাপেন্ড’? মুহুর্তের মধ্যেই পাশের গাড়ী থেকে আমাদের গাড়ীকে লক্ষ করে ছুড়ে দেওয়া হলো ডিম! আমরা দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে সবুজ বাতি ফলো করে পথ চলতে শুরু করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম এই তরুণদের চুলে ঝুটি বাঁধা ছিলো, সংখ্যায় তারা ৩/৪ জন হবে। তাদের বয়সও ১৫ থেকে ১৭ এর মধ্যে হবে। ধারণা করি তারা গাড়ীতে ডিম নিয়েই চলা ফেরা করে। রাস্তায় মানুষকে অহেতুক বিব্রত করা/অপদস্ত করাই তাদের শখ। তারা কোন ব্যক্তি বিশেষকে লক্ষ করে ডিম ছুড়েছে বলে মনে হলো না, মন চাইলো ডিম ছুড়ে একটু মজা নিলাম এই টাইপের একটা ঘটনা। দিন শেষে তারা হয়তো হিসেব কষবে কত ডজন ডিমে কতজনকে লক্ষবস্তুতে পরিণত করা গেলো!
একটা সময় এই বেথনালগ্রীন বা ব্রিক লেইনের এসব এলাকাতেই স্কিন হেইডেড শেতাঙ্গরা বাঙালিদের উপর এভাবে আক্রমন চালাতো। সংঘবদ্ধ বাঙালিরা তাদের রুখে দিয়ে পূর্ব লন্ডনে আধিপত্য নিয়েছে। এই টাওয়ার হ্যামলেটে এখন সবচেয়ে বেশী বাঙালি কাউন্সিলর। এখান থেকেই রুশনারা গেছেন ওয়েস্টমিনষ্টার পার্লামেন্টে! আজ এই পূর্ব লন্ডনের বাঙালি তরুণরাই এখন স্থানীয় বাঙালিদেরও এভাবে উত্তক্ত করতে ছাড়ছে না! বিভাজনের কারনে পূর্ব লন্ডনের রাজনীতি এখন স্প্রিন্টারের স্ফুলিঙ্গের মতো বিষবাস্প ছড়াচ্ছে। কখনো কখনো আমরা টাওয়ার হ্যামলেটসকে ইসলামিক রিপাবলিক অব টাওয়ার হ্যামলেটস বলে বিশেষায়িত করতে শুনে থাকি। এই অঞ্চলের বখে যাওয়া তরুণদের ডিম কান্ড দেখে টাওয়ারহ্যামলেটসকে ‘ওমলেট’ রিপাবলিক অব টাওয়ার হ্যামলেটস বললে ভুল হবে না। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতিবিদদের বলি, আপনারা দয়া করে এই কিশোর/তরুণদের নিয়ে একটু ভাবুন। আমাদের এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারলে আপনাদের কাউন্সিলর হওয়া বা ওয়েস্টমিনষ্টারে যাওয়া আসলেই অর্থহীন।
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯