ইউকে শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
হেডলাইন

‎জেনারেল ওসমানীর অপরাধ‎ ‎!

ফরীদ আহমদ রেজা: আমরা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা কথা শুনি, তাদের প্রতি ‎শ্রদ্ধা জানাই। মুক্তিযুদ্ধের ‎লড়াই শুধু যুদ্ধের ময়দানে হয়নি, সকল সেক্টরে তা পরিব্যপ্ত ছিল। সকল ‎সেক্টরের কাজকে আমরা মূল্যায়ন করি। মুক্তিযুদ্ধের ‎সময় লড়াইয়ের ময়দানে জেনারেল ওসমানী ‎ছিলেন প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি। কিন্তু আজকাল মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় তাঁর কথা ‎খুব একটা শোনা যায় ‎না। তাঁর ব্যক্তিগত শুদ্ধাচার, ভিন্নধর্মী রাজনীতি অথবা গৌরবমন্ডিত সৈনিক জীবনের আলোচনা ‎কদাচিৎ ‎‎কোথাও চোখে পড়ে। এর মানে কি আমরা জেনারেল ওসমানীকে ভুলে গিয়েছি, না কি ‎আমাদের নানা অসঙ্গতি ও দ্বিমুখি ‎আচরণের কারণে তাঁর কথা আলোচনা করতে আমরা ভয় পাই ? ‎তাঁর নিখাদ দেশপ্রেম এবং কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবনের ‎পাশে দাঁড়ালে আমাদের রাজনৈতিক শঠতা ‎ও ক্ষমতার গোলামী আরো কদর্যভাবে ফুটে উঠবে ভেবে কি আমরা শঙ্কিত?‎

‎আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যস্ত, আর বিএনপি ব্যস্ত তাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। ‎বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর ‎রহমান তারা কেউ-ই নিঃসন্দেহে ছোট মাপের নেতা ছিলেন না। তাদের কথা ‎আমরা আলোচনা করবো ভবিষ্যৎ ‎নির্মাণের উদ্দেশ্যে, বানিজ্যের জন্যে নয়। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ‎সার্বভৌম ভূখন্ড বহু সাধারণ এবং বহু অসাধারণ ‎ব্যক্তির অবদানের ফসল। অসাধারণ মানুষের মধ্যে ‎জেনারেল ওসমানী অন্যতম। তাঁকে আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি ‎না। বিস্ময়ের বিষয়, দেশের বড় ‎দুটি দলের কেউ-ই ওসমানীর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেন না। অথচ উভয় দলই বিভিন্ন ‎সময়ে তাঁর ‎প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। বর্তমানে তাদের কাছে জেনারেল ওসমানীর ‎‎বানিজ্যমূল্য নেই বলেই কি তারা তাঁর নাম নিচ্ছেন না?‎

‎জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ ‎থেকে নির্বাচিত এম ‎পি এবং মন্ত্রী। অবশ্য জেনারেল ওসমানী সর্বাধিনায়ক ছিলেন, না কি প্রধান ‎সেনাপতি ছিলেন তা নিয়ে আওয়ামী ‎ঘরানার পক্ষ থেকে বিতর্ক উত্থাপন করা হয়। যুদ্ধকালীন সময় ‎অথবা সামরিক শাসনের সময় যে কেউ সর্বাধিনায়ক হতে ‎পারে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে জেনারেল ‎ওসমানীকে কামান্ডার ইন চিফ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে কোন ‎বিতর্ক নেই। বিতর্ক হচ্ছে ‎কামান্ডর ইন চিফ’র বাংলা কি হবে তা নিয়ে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কোন ‎সিদ্ধান্ত ‎নিয়েছে কি না আমার জানা নেই। তবে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার শুনেছেন তারা সেখানে জেনারেল ‎ওসমানীকে ‎সর্বাধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করতে শুনেছেন। অবশ্য কাকে কি উপাধি দেয়া হলো তাতে ‎খুব একটা যায় আসে না। ‎একজনের কাজই সাক্ষ্য দিবে তিনি কি ছিলেন। স্বাধীনতার লড়াইয়ে ‎জেনারেল ওসমানীর নাম অক্ষয় হয়ে আছে। ‎কারো ঘৃণা, উপেক্ষা বা স্বার্থপরতার কারণে তাঁর নাম ‎ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না।‎
পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ জেনারেল ওসমানীকে সামনে নিয়েই সর্বপ্রথম মাঠে নামে গণতান্ত্রিক ‎ঐক্যজোটের ‎ব্যানারে। আজ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ঘরানার প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী তাঁকে ‎সযতেœ পরিহার করে চলেন। যে ‎‎দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তারা এখন ক্ষমতায়। ‎সুতরাং কেউ যদি আশা করে, এখন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ‎সামরিক ব্যক্তিত্বকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হবে, ‎করা হবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন তা হলে নিশ্চয়ই তার আশা অযৌক্তিক বা ‎অন্যায় নয়।

কিন্তু আমরা ‎অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ‎‎জেনারেল ‎ওসমানীকে এড়িয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রধানকে বাদ দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‎জাগ্রত ‎করতে ও উর্ধে তুলে ধরতে চায়। ‎কিন্তু তা কি কখনো সম্ভব ?‎ সত্যিকথা বলতে কি জেনারেল ‎ওসমানীর দুর্ভাগ্য যে তার ‎জন্ম বাংলাদেশে হয়েছে। ইউরোপীয় কোন দেশে জন্ম হলে সে দেশের ‎শিশু-কিশোরগণ তাঁর জীবন কাহিনী ‎পাঠ্যপুস্তকে পাঠ করার সুযোগ পেতো এবং বিশ্ববিদ্যালয় ‎পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর রাষ্ট্রনীতি নিয়ে গবেষণা করে ‎উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতো। বাংলাদেশের ‎মতো দেশের জন্যে তিনি ছিলেন বেমানান। ‎

আমরা জানি, আজকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততার তেমন মূল্য নেই। ন্যায়-নীতি মেনে চলে ‎সেখানে রাজনীতি ‎করা যায়না। তোষামোদে ও ধোকাবাজদেরই সেখানে জয়জয়কার। জেনারেল ‎ওসমানী তোষামোদ পছন্দ করতেন না ‎এবং রাজনৈতিক ধোকাবাজদের তিনি ছিলেন দুশমন। তাঁর ‎সবচেয়ে বড় দোষ এটাই ছিল, তিনি ছিলেন অসম্ভব রকম ‎এক সৎ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সততা, নীতির প্রশ্নে ‎আপোসহীনতা ও ন্যায়পরায়নতার অসংখ্য কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ‎এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ‎রয়েছে। সততাই তাঁর রাজনীতির জন্যে কাল হয়েছে। এ ধরণের সৎ মানুষকে বাংলাদেশের ‎মানুষ দূর ‎থেকে সালাম দেয় ও শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কাছে টেনে নিতে ভয় করে। থানার দালালী, মোকদ্দমার ‎তদবির, ‎পারমিট-লাইসেন্স, লুটপাট এবং সকল প্রকার দুনম্বরী কাজে এরা অচল মাল।‎

‎জেনারেল ওসমানীকে আমি প্রথম দেখি ৭০ সালে, সিলেটের নাইওরপুল মসজিদে। আমি থাকতাম ‎কুমার পাড়া, ‎নামাজ পড়তাম নাইওরপুল মসজিদে। সিলেটে এলে তিনিও নাইওরপুল মসজিদে ‎নামাজ পড়তে আসতেন। প্রথম দিন ‎‎দেখার পর দূর থেকে তাঁকে সালাম দিয়েছি, কাছে ভিড়ার বা হাত ‎মেলানোর সাহস দেখাইনি। তাঁর কড়া মেজাজ ‎সম্পর্কে বহু কথা শোনার কারণে ‎নিজের মনের মধ্যে ‎তাঁর জন্যে ভালোবাসা থাকলেও ভয় সেখানে প্রবল ছিল। এর ‎পর আরো অনেকবার তাঁর সাথে দেখা ‎হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। তাঁর কথা শুনেছি, কথা বলার সাহস হয়নি। না, ‎মুক্তিযুদ্ধের কথা তিনি ‎সরাসরি বলতেন না। আকারে ইঙ্গিতে বলতেন। বলতেন, আত্মকথা লিখছি, সেখানে অনেক ‎অকথিত ‎কথা জানতে পারবে। ইতিহাসের আলোচনা করতেন রহস্যময় ভাষায়। দেশের জনগণ নিয়ে কথা ‎বলতেন, ‎বলতেন আদর্শ ব্যক্তিত্ব বা রোউল মডেলের কথা। ‎

‎৮৬ সালে সিলেটের সাপ্তাহিক সমাচার-সম্পাদক আব্দুল ওয়াহিদ খান জেনারেল ওসমানীর জীবন ও ‎কর্ম নিয়ে একখানা ‎গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সম্পাদনার দায়িত্ব ‎আমার উপর অর্পন করেন। দায়িত্ব ‎গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে আমি সিলেট ছেড়ে চলে আসায় ‎সম্পাদনার মহৎ কাজটি সম্পন্ন করতে পারিনি। তবে এ ‎সুবাদে জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে জানার ‎জন্যে বহুলোকের সাথে কথা বলেছি এবং তাঁর সম্পর্কে লেখা বই-পুস্তক ও ‎প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ ‎পেয়েছি। ‎

‎জেনারেল ওসমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ট একজন বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস তিনি জেনারেল ‎ওসমানীর সহকারী ‎হিসেবে কাজ করেন। জেনারেল ওসমানীর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন পীর, তাঁর নিজ ‎ভাষায় সেইন্ট বা পূতপবিত্র চরিত্রের ‎অধিকারী। আলোচ্য এ বন্ধুর নাম এ আর চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত ‎লে. কর্নেল। জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে জানার জন্যে ‎আমি তাঁর সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। ‎সিলেট প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হারুনুজ্জামান চৌধুরীর সাথে এ ‎আর চৌধুরীর খাদিম নগরের ‎গ্রিনহিল বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি মুক্তিযুদ্ধ ও জেনারেল ওসমানীকে ‎নিয়ে। ‎হারুনুজ্জামান চৌধুরী তখন সাপ্তাহিক জালালাবাদের সম্পাদক, অফিস ছিল ধোপাদিঘির পূর্বপার। ‎আমি সেখানে ‎নিয়মিত হাজিরা দিতাম। এ আর চৌধুরী মাঝে মাঝে সেখানে এসে বসতেন। তখন তাঁর ‎কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‎শুনতাম, শুনতাম তাদের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কথা। ‎

‎জেনারেল ওসমানী অনেকের সাথে আলাপচারিতার সময় মাঝে মাঝে বলতেন, তিনি আত্মকথা ‎লিখছেন। এ নিয়ে ‎সাংবাদিক মহলসহ সকলের মনে খুব কৌতুহল ছিল। তবে খারাপ চরিত্রের ‎লোকেদের মধ্যে ছিল ভয়। জেনারেল ‎ওসমানী কাউকে ছেড়ে কথা বলার লোক নয়, এ কথা কারো ‎অজানা ছিল না। আত্মকথা লেখার সুযোগে তিনি অসৎ বা ‎‎দুনম্বরী লোকদের চরিত্র সবার সামনে ‎উন্মোচন করে দিবেন ভেবে তারা শঙ্কিত ছিল। ইন্তেকালের পর তাঁর ‎আত্মজীবনীর অন্বেষণ শুরু হয়। ‎অনেক খোঁজাখুজি করেও এর কোন হদিস পওয়া যায়নি। তখন অনেকে বলতে শুরু ‎করেন, কোন দুষ্ট ‎লোক হয়তো আত্মজীবনী লুকিয়ে ফেলেছে। ‎

কর্নেল এ আর চৌধুরীকে আমি এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করি। জবাবে তিনি যা বলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‎তিনি বলেন, ‎‘আমার মনে হয় ওসমানী সাহেব আত্মজীবনী লেখে যাননি। এর কারণ, আত্মজীবনী ‎লেখলে সেখানে তাঁকে অনেক ‎অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হতো। অপ্রিয় সত্য বলতে ওসমানী সাহেব ‎ভীত ছিলেন না। তাঁর ভয় ছিল অন্য খানে। আমরা ‎সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের মধ্যে ‎আদর্শ ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুব কম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে হলে ‎তাদের সামনে রউল মডেল ‎হিসেবে কিছু মানুষ থাকতে হবে, রাখতে হবে। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা ‎‎দোষত্রুটির ‎উর্ধে নয়। ওসমানী সাহেবের সত্যকথনের ফলে তরুণদের মনে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ‎নেতাদের ‎ব্যাপারে খারাপ ধারণা তৈরি হতে পারে যা দেশের ভবিষতের জন্যে ভালো হবে না। দেশের ‎ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তিনি ‎আত্মকথা লেখার ইচ্ছা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’ এ আর চৌধুরীর মতে, ‎জেনারেল ওসমানীর মতো দেশপ্রেমিক ও ‎‎দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার জন্যে কাজটা যথাযথ হয়েছে। কারণ ‎জাতীয় নেতাদের চরিত্র হনন কোন দেশের জন্যেই ‎কল্যাণকর নয়। ‎

‎জেনারেল ওসমানীর আত্মজীবনী সম্পর্কে কর্নেল এ আর চৌধুরীর এ মতের সাথে অনেকে ভিন্নমত ‎পোষণ করেন। ‎সাংবাদিক ও লেখক ইসহাক কাজলের মতে, জেনারেল ওসমানী আত্মজীবনী লিখে ‎গিয়েছেন। চিকিৎসার জন্যে লন্ডনে ‎আসার সময় তিনি তা লন্ডনে নিয়ে আসেন। তাঁর ইন্তেকালের পর ‎লন্ডন থেকেই তা গায়েব করে দেয়া হয়েছে। কারা ‎গায়েব করে দিয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ‎তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের প্রতি ইঙ্গিত করেন।‎

ওপরদিকে জেনারেল ওসমানীর ঘনিষ্টজন, জাতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও ‎দফতর সম্পাদক ‎ইকবাল হোসেন চৌধুরীর মতে, জেনারেল ওসমানী তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন ‎এবং তা প্রকাশের ব্যাপারে লন্ডনে ‎অবস্থানকালে বৃটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস এন্ড ‎পাবলিকেশনের সাথে কথাবার্তাও বলেছেন। ইকবাল হোসেন ‎‎চৌধুরীকে বইটির ভূমিকা পাঠ করার ‎জন্যে জেনারেল ওসমানী নিজে দিয়েছেন। ইকবাল হোসেন চৌধুরী এ ব্যাপারে ‎নিশ্চিত, জেনারেল ‎ওসমানী অসুস্থ অবস্থায় লন্ডন আসার সময় বইটির পা-ুলিপি তাঁর সাথে ছিল না। প্রকাশনা সংস্থার ‎‎সাথে কথা ছিল, দেশে গিয়ে তিনি আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।‎

‎জেনারেল ওসমানী তাঁর আত্মজীবনী লিখে গেছেন, এ কথা মেনে নিলেও তাঁর ইন্তেকালের পর তা ‎পাওয়া গেছে বলে ‎‎কেউ দাবি করেননি। আর কে বা কারা তা গায়েব করেছেন সে ব্যাপারে আমরা ‎অনুমানের উপর নির্ভর করে কথা ‎বলতে পারি, কিন্তু নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে এ কথা বলা ‎যায়, তিনি আত্মজীবনী লিখে থাকলে তা প্রকাশিত ‎হলে যাদের স্বার্থ বা সুনাম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ‎সম্ভাবনা ছিল তাদেরই কেউ তা গায়েব করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা ‎আমাদের জাতীয় জীবনের জন্যে ‎এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর আত্মজীবনী থেকে আমরা শুধু তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ‎জানতাম না, ‎সেখানে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও রণকৌশল সম্পর্কে নির্ভুল ও বস্তুনিষ্ঠ অনেক অজানা ‎তথ্য ‎‎পেতাম।

‎সে যা-ই হোক, ব্যক্তিগত পড়াশোনা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে ‎আমি যতটুকু জেনেছি ‎তা থেকে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বিভিন্ন দিক দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ‎শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরার মত ‎এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। এ ধরণের ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে খুব ‎কমই আছে। সততা, ন্যায়পরায়নতা এবং গণতান্ত্রিক ‎মূল্যবোধের প্রতি আস্থার কারণে তিনি দলমত ‎নির্বিশেষে সকল মহলের কাছে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আমরা ‎যদি তাঁকে মূল্য না দেই বা না ‎দিতে পারি তা হলে তা হবে আমাদের নিজেদের অযোগ্যতা ও দীনতা। ‎

বাংলাদেশে যে রাজনীতি দেখে আমরা অভ্যস্ত সেখানে মন্ত্রীত্ব থেকে কি কেউ পদত্যাগ করে? ‎জেনারেল ওসমানী ‎বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। আমরা আরো দেখি, ‎কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে সেখানে ‎সবাই যে ভাবেই হোক পাশ করতে চায়। বৈধ-‎অবৈধের প্রশ্ন তখন ‎গৌন হয়ে যায়। কিন্তু জেনারেল ওসমানীর বেলায় ‎আমরা দেখি এক স¤পূর্ণ ভিন্ন ‎চিত্র। এক নির্বাচনের ‎সময় তাঁর কয়েকজন নির্বাচন-কর্মীকে অবৈধ ভোট প্রদানের দায়ে ‎‎গ্রেফতার ‎করা হয়। আওয়ামী ‎লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়া কর্মীদের মুক্ত করতে গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ‎‎কর্মকর্তা বলে ‎দেন, ওসমানী সাহেব অনুরোধ করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। জেনারেল ওসমানীর ‎কাছে এ খবর ‎‎‎পৌঁছলে তিনি ঠিকই থানায় ফোন করেন। ফোন করে তিনি কি বলেন জানেন? তিনি ‎বলে দেন, ‎‎‘ওদের কেউ ‎জালভোট দিয়েছে তা প্রমাণিত হলে এ জন্যে যে শাস্তি রয়েছে তা-ই যেন ‎তাদের দেয়া ‎হয়।’ বাংলাদেশে কি এর কোন ‎দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবেন?‎

আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বাঙালির ১০টার সভা ১২টায় শুরু হয়, এটা আমরা সবাই জানি। ‎এক নির্বাচনের ‎সময় তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান সকাল ‎১০ টায় ‎শুরু হওয়ার কথা ছিল। ‎‎জেনারেল ওসমানী যথা সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখেন, ‎উদ্যোক্তাদের ‎কেউ তখনো সেখানে আসেননি। তিনি মন ‎খারাপ করে সভাস্থলে বসে থেকে স্থানীয় ‎নেতাদের জন্যে অপেক্ষা করেননি, বরং তখনই সভাস্থল ‎ত্যাগ করে চলে ‎আসেন। উপস্থিত কিছু ‎লোক অনেক অনুরোধ করেও তাঁকে সেখানে ধরে রাখতে ‎পারেননি।‎

‎জেনারেল ওসমানীর জীবনে এ রকম অসংখ্য ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। ‎প্রশ্ন হচ্ছে, ‎কেন তাঁকে মূল্যায়ন ‎করা হয়না, কি তাঁর অপরাধ? কেউ কেউ বলেন কঠোর নীতিনিষ্ঠা ও ‎‎¯পষ্টবাদিতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা ‎রাখার পরও তিনি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছেন না। অপর ‎কিছু লোকের মতে আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয় ছেড়ে আসাই তাঁর ‎সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ ‎কারণেই অওয়ামী লীগের অনেকে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে স্বীকার করতে চায়না। ‎তাদের ‎মতে তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। একজন প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আরো এগিয়ে গিয়ে জেনারেল ‎ওসমানীকে ভীরু ‎ও কাপুরুষ হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ সকল মিথ্যাচার যদি এখন ‎সংশোধন করা না হয় তা হলে ‎পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্ব নিছক ‎নামসর্বস্ব একজন নায়ক হিসেবে বেঁচে থাকবেন।‎

‎‘চরমপত্রের’এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থে জেনারেল ওসমানীর ‎ব্যাপারে এমন সব কথা ‎বলেছেন যার সাথে আমাদের পরিচিত জেনারেল ওসমানীর শুধু কোন মিল যে ‎নেই তা নয়, তাঁর ব্যাপারে অন্যান্যদের ‎বর্ণনারও সামঞ্জস্য সেখানে নেই। মনে হয় কোন পূর্বশত্রুতার ‎জের ধরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তিনি জেনারেল ‎ওসমানীর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন। আমাদের ‎শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আব্দুল আজিজ ‘তিনি বিজয় দেখেছেন, ওসমানী ‎‎দেখেননি’ শিরোনামে তাঁর কথার ‎চমৎকার জবাব দিয়েছেন।‎

‎রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানী কেন উপস্থিত ‎‎ছিলেন না, এ কথা ‎তখন যেমন উত্থাপিত হয়েছে, তেমনি এখনো অনেকের মনে এ ব্যাপারে প্রশ্ন ‎‎রয়েছে। এম আর আখতার মুকুলের ‎মতে জেনারেল ওসমানী ভয়ে সেখানে হাজির হননি। ‎যার কারণে ‎তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদ বাধ্য হয়ে ‎গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে ‎সেখানে ‎পাঠান। তিনটি বড় বড় যুদ্ধে সরাসারি অংশ গ্রহণের গৌরব যার জীবনকে ‎মহিমান্বিত করে রেখেছে ‎তাঁকে ভীরু বা কাপুরুষ বলার মতো হাস্যকর কথা আর হয় না। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ ‎‎‎দলিলপত্র’ ১৫শ খন্ডে জনাব এ কে খোন্দকারের ‎একটি সাক্ষাতকার রয়েছে। সেখানে এ কে ‎খোন্দকার নিজে ‎‎¯পষ্টভাবে বলেন, সে সময় ওসমানী সাহেব ‎মুজিব নগরে ছিলেন না বলেই তাকে (এ ‎কে খোন্দকারকে) আত্মসমর্পণ ‎অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ‎সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়।‎

এ স¤পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন-প্রধান এবং সাবেক ¯পীকার ‎হুমায়ুন রশীদ ‎‎চৌধুরী ভিন্ন ধরণের বক্তব্য রেখেছেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং ‎সিআইএ’ গ্রন্থে প্রকাশিত সাক্ষাতকারে ‎তিনি ভারত সরকারের সাথে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ‎স¤পাদিত গোপন সাত দফা চুক্তির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ‎তাঁর বর্ণনা মতে, চুক্তির মধ্যে এ কথা ছিল যে ‎সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী ‎প্রধান, মুক্তিবাহিনীর ‎সর্বাধিনায়ক নন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনে থাকবে। চুক্তির এ ‎‎অনুচ্ছেদটির কথা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে জানানো হলে তীব্র ক্ষোভে তিনি ‎ফেটে পড়েন। এর ‎প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি ‎উপস্থিত থাকেননি।‎

‎যে যা-ই বলুন না কেন এ ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীর নিজের কথাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ‎নিজে ভাল করে ‎জানেন কেন তিনি সে অনুষ্ঠানে থাকেননি। তিনি কেন পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ‎অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, ‎‎জেনারেল ওসমানীকে বহু সময় এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ‎যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে ‎মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ ‎কর্মকর্তার দায়িত্বে ‎ছিলেন নজরুল ইসলাম। ‘একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু ‎কথা’ ‎নামক স্মৃতিকথায় তিনি বলেন,‎ ‎১৮ ডিসেম্বর রণাঙ্গন থেকে সদর দপ্তরে ফিরে এলে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তাঁর ‎অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ‎কথা শুনে জেনারেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হন। তখন তিনি বলেন,‎
‎‘দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে ‎আত্মমর্যাদাবোধ ‎স¤পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর ‎সুযোগটা ‎কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। ‎তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান – ‎পাকিস্তানি ‎সেনাবাহিনী কবে অত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি ‎কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‎তাদের অত্মসমর্পণের প্রস্তাব ‎এসেছে।’‎

‎‘নাম্বার টু – ঢাকায় আসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-‎বাংলাদেশের যৌথ ‎কমান্ডের অধীনে হলেও ‎যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় ‎সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল ‎স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি ‎আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‎কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। ‎আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান ‎সেনাবাহিনী আমার কাছে ‎আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ ‎‎জেনেভা কনভেনশনে ‎স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন ‎‎লে. ‎জে. অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। ‎সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে ‎আমার ‎অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান ‎জেনারেল অরোরার ‎সফরসঙ্গী ‎আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের‏ ‏‏ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা ‎হয়েছে। আমাদের ‎মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় ‎অভাব। ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল ‎মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার ‎কমান্ডের ‎অধীন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ‎ভারতীয় বাহিনীর ‎কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার ‎পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? ‎হাও ‎ক্যান আই! আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ ‎সিং ‎অরোরা ‎আর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা ‎আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া ‎করা হচ্ছে।’‎

‎১৯৮০ সালের স্বাধীনতা সংখ্যা রোববারে প্রকাশিত অপর এক সাক্ষাতকারে জেনারেল ওসমানী ‎বলেন, ‘তখন আমি ‎ছিলাম রণাঙ্গন সফরে। তবে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী ‎জানতেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। ‎কিন্তু তবু আমাকে কোন খবর দেয়া হয়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী ‎বাংলাদেশ সরকার আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে পাঠান আমার ডিপুটি ‎চীফ অব ষ্টাফ তদানীন্তন ‎গ্রুপক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে। উপরোক্ত বাস্তব তথ্য ও পারবর্তী ঘটনাবলী থেকে এটাই ‎‎প্রতীয়মান হয় যে ‎ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মহান ব্যক্তিবর্গ (স্ব স্ব কারণে ও ‎উদ্দেশ্যে) চাইতেন ‎না ‎যে এ আত্মসমর্পণ বাংলাদেশ তথা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের কাছে ‎হোক।’‎

‎জেনারেল ওসমানীর এ ‎বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে গেছে, এম আর আখতার মুকুল’র কথা ‎একটা বানানো কথা ‎মাত্র। ‎
‎জেনারেল ওসমানীর অপরাধ কি যার কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা প্রধান সামরিক ‎ব্যক্তিত্ব হয়েও সমাদর ‎পাচ্ছেন না ? তাঁর প্রথম অপরাধ হচ্ছে, (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ভাষ্য ‎অনুসারে) ভারতের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ ‎সরকারের স¤পাদিত সাতদফা গোপন চুক্তির সাথে ‎দ্বিমত পোষণ করা। দ্বিতীয়তঃ ১৯৭৪ সালের মে মাসে চিঠি দিয়ে ‎বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ ‎করা এবং পরবর্তীতে সে চিঠি প্রকাশ করে দেয়া। তৃতীয়তঃ বাকশাল তথা একদলীয় ‎শাসন প্রতিষ্ঠার ‎প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদ থেকে এ বলে পদত্যাগ করা যে ‘চতুর্থ সংশোধনীর অর্থ হল ‎‎জনগণের সাথে প্রতারণা করা।’ ‎

উল্লেখ্য, বিশ্বত্বসূত্র মতে জেনারেল ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগ দেন বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে। তখনই ‎তিনি গণনীতি ও ‎ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করার ‎জন্যে বঙ্গবন্ধুকে শর্ত দেন এবং ‎বঙ্গবন্ধু তা মেনে নেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ‎আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ৭০’র নির্বাচনে ‎তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ নির্বাচনী এলাকা ‎থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।‎

তাঁর চতুর্থ অপরাধ অপেক্ষাকৃত গুরুতর। ৭৫’র পটপরিবর্তনের পর বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা ‎করে খোন্দকার ‎‎মোশতাককে তিনি শুরুর দিকে কিছুটা সহযোগিতা প্রদান করেন। খোন্দকার ‎মোশতাক তাঁকে প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ‎পদ গ্রহণ ‎করতে অনুরোধ করলে তিনি তা ঘৃণাভরে ‎প্রত্যাখ্যান করেন। পরে যখন খোন্দকার মোশতাক সংসদীয় ‎গণতন্ত্র ‎পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন ‎তখন জেনারেল ওসমানী শপথ না নিয়ে অবৈতনিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ‎হিসেবে ‎‎দায়িত্ব পালনে সম্মত ‎হন। আসলে জেনারেল ওসমানী তখন খোন্দকার মোশতাককে ‎সহযোগিতা নয়, জাতীয় সংকট ‎‎মুহূর্তে জাতিকে সেবা প্রদান করেছেন। তখন সেনাবহিনীর চেইন অব ‎কমান্ড ভেঙে পড়েছিল এবং তা ‎পুনঃস্থাপনে ‎‎জেনারেল ওসমানীর সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। পরে ‎জেলহত্যার প্রতিবাদে তিনি ‎খোন্দকার মোশতাকের সাথে ‎সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। ‎

‎১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও ‎তিনি একই ভাবে ‎‎গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন জাতীয় সংকট মুহুর্তে তাঁর ভূমিকা স¤পর্কে ‎শুধু তারাই প্রশ্ন তুলতে পারে ‎যাদের বোচকা বা দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে ওঠে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ ‎পেয়ে গেছে।‎
‎জেনারেল ওসমানী সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদ ছিলেন না। চাটুকারিতা ও কপটতাকে তিনি কখনো ‎প্রশ্রয় দেননি। ‎রাজনীতি বলতে তিনি গণনীতি বুঝতেন। রাজনীতি তাঁর পেশা ছিলনা। লুটপাট ‎সমিতির যারা সদস্য তারা তাঁর কাছে ‎‎যেতেই ভয় পেতো। তার সততা, ন্যায়নিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ‎আদর্শের প্রতি ‎অঙ্গীকার ছিল তুলনাহীন। জেনারেল ‎ওসমানীর আসল এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ ‎এটাই। জেনারেল ওসমানীর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সামনে লুটেরা ও ‎‎ধোকাবাজরা নিস্প্রভ হয়ে পড়বে, এ ‎ভয় থেকেই তাঁকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‎আমাদের শিশু-‎কিশোর এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ‎ধরার মতো উন্নত চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিত্বের খুব ‎অভাব। ‎ভবিষ্যত প্রজন্মকে সৎ এবং দেশপ্রেমিক ‎নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জেনারেল ‎ওসমানীর জীবনের বিভিন্ন দিক ‎বার বার তাদের সামনে ‎উপস্থাপন করা দরকার বলে আমরা মনে ‎করি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব। ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ‘মুক্তমত’ বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় ‘ইউকে বাংলা অনলাইন ডট কম’ এর নয়। - সম্পাদক

সর্বশেষ সংবাদ

ukbanglaonline.com