ফরীদ আহমদ রেজা: আমরা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা কথা শুনি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। মুক্তিযুদ্ধের লড়াই শুধু যুদ্ধের ময়দানে হয়নি, সকল সেক্টরে তা পরিব্যপ্ত ছিল। সকল সেক্টরের কাজকে আমরা মূল্যায়ন করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় লড়াইয়ের ময়দানে জেনারেল ওসমানী ছিলেন প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি। কিন্তু আজকাল মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় তাঁর কথা খুব একটা শোনা যায় না। তাঁর ব্যক্তিগত শুদ্ধাচার, ভিন্নধর্মী রাজনীতি অথবা গৌরবমন্ডিত সৈনিক জীবনের আলোচনা কদাচিৎ কোথাও চোখে পড়ে। এর মানে কি আমরা জেনারেল ওসমানীকে ভুলে গিয়েছি, না কি আমাদের নানা অসঙ্গতি ও দ্বিমুখি আচরণের কারণে তাঁর কথা আলোচনা করতে আমরা ভয় পাই ? তাঁর নিখাদ দেশপ্রেম এবং কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবনের পাশে দাঁড়ালে আমাদের রাজনৈতিক শঠতা ও ক্ষমতার গোলামী আরো কদর্যভাবে ফুটে উঠবে ভেবে কি আমরা শঙ্কিত?
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যস্ত, আর বিএনপি ব্যস্ত তাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমান তারা কেউ-ই নিঃসন্দেহে ছোট মাপের নেতা ছিলেন না। তাদের কথা আমরা আলোচনা করবো ভবিষ্যৎ নির্মাণের উদ্দেশ্যে, বানিজ্যের জন্যে নয়। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ড বহু সাধারণ এবং বহু অসাধারণ ব্যক্তির অবদানের ফসল। অসাধারণ মানুষের মধ্যে জেনারেল ওসমানী অন্যতম। তাঁকে আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। বিস্ময়ের বিষয়, দেশের বড় দুটি দলের কেউ-ই ওসমানীর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেন না। অথচ উভয় দলই বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। বর্তমানে তাদের কাছে জেনারেল ওসমানীর বানিজ্যমূল্য নেই বলেই কি তারা তাঁর নাম নিচ্ছেন না?
জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচিত এম পি এবং মন্ত্রী। অবশ্য জেনারেল ওসমানী সর্বাধিনায়ক ছিলেন, না কি প্রধান সেনাপতি ছিলেন তা নিয়ে আওয়ামী ঘরানার পক্ষ থেকে বিতর্ক উত্থাপন করা হয়। যুদ্ধকালীন সময় অথবা সামরিক শাসনের সময় যে কেউ সর্বাধিনায়ক হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে জেনারেল ওসমানীকে কামান্ডার ইন চিফ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। বিতর্ক হচ্ছে কামান্ডর ইন চিফ’র বাংলা কি হবে তা নিয়ে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না আমার জানা নেই। তবে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার শুনেছেন তারা সেখানে জেনারেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করতে শুনেছেন। অবশ্য কাকে কি উপাধি দেয়া হলো তাতে খুব একটা যায় আসে না। একজনের কাজই সাক্ষ্য দিবে তিনি কি ছিলেন। স্বাধীনতার লড়াইয়ে জেনারেল ওসমানীর নাম অক্ষয় হয়ে আছে। কারো ঘৃণা, উপেক্ষা বা স্বার্থপরতার কারণে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না।
পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ জেনারেল ওসমানীকে সামনে নিয়েই সর্বপ্রথম মাঠে নামে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের ব্যানারে। আজ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ঘরানার প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী তাঁকে সযতেœ পরিহার করে চলেন। যে দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তারা এখন ক্ষমতায়। সুতরাং কেউ যদি আশা করে, এখন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্বকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হবে, করা হবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন তা হলে নিশ্চয়ই তার আশা অযৌক্তিক বা অন্যায় নয়।
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জেনারেল ওসমানীকে এড়িয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রধানকে বাদ দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে ও উর্ধে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু তা কি কখনো সম্ভব ? সত্যিকথা বলতে কি জেনারেল ওসমানীর দুর্ভাগ্য যে তার জন্ম বাংলাদেশে হয়েছে। ইউরোপীয় কোন দেশে জন্ম হলে সে দেশের শিশু-কিশোরগণ তাঁর জীবন কাহিনী পাঠ্যপুস্তকে পাঠ করার সুযোগ পেতো এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর রাষ্ট্রনীতি নিয়ে গবেষণা করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতো। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যে তিনি ছিলেন বেমানান।
আমরা জানি, আজকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততার তেমন মূল্য নেই। ন্যায়-নীতি মেনে চলে সেখানে রাজনীতি করা যায়না। তোষামোদে ও ধোকাবাজদেরই সেখানে জয়জয়কার। জেনারেল ওসমানী তোষামোদ পছন্দ করতেন না এবং রাজনৈতিক ধোকাবাজদের তিনি ছিলেন দুশমন। তাঁর সবচেয়ে বড় দোষ এটাই ছিল, তিনি ছিলেন অসম্ভব রকম এক সৎ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সততা, নীতির প্রশ্নে আপোসহীনতা ও ন্যায়পরায়নতার অসংখ্য কাহিনী মানুষের মুখে মুখে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সততাই তাঁর রাজনীতির জন্যে কাল হয়েছে। এ ধরণের সৎ মানুষকে বাংলাদেশের মানুষ দূর থেকে সালাম দেয় ও শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কাছে টেনে নিতে ভয় করে। থানার দালালী, মোকদ্দমার তদবির, পারমিট-লাইসেন্স, লুটপাট এবং সকল প্রকার দুনম্বরী কাজে এরা অচল মাল।
জেনারেল ওসমানীকে আমি প্রথম দেখি ৭০ সালে, সিলেটের নাইওরপুল মসজিদে। আমি থাকতাম কুমার পাড়া, নামাজ পড়তাম নাইওরপুল মসজিদে। সিলেটে এলে তিনিও নাইওরপুল মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন। প্রথম দিন দেখার পর দূর থেকে তাঁকে সালাম দিয়েছি, কাছে ভিড়ার বা হাত মেলানোর সাহস দেখাইনি। তাঁর কড়া মেজাজ সম্পর্কে বহু কথা শোনার কারণে নিজের মনের মধ্যে তাঁর জন্যে ভালোবাসা থাকলেও ভয় সেখানে প্রবল ছিল। এর পর আরো অনেকবার তাঁর সাথে দেখা হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। তাঁর কথা শুনেছি, কথা বলার সাহস হয়নি। না, মুক্তিযুদ্ধের কথা তিনি সরাসরি বলতেন না। আকারে ইঙ্গিতে বলতেন। বলতেন, আত্মকথা লিখছি, সেখানে অনেক অকথিত কথা জানতে পারবে। ইতিহাসের আলোচনা করতেন রহস্যময় ভাষায়। দেশের জনগণ নিয়ে কথা বলতেন, বলতেন আদর্শ ব্যক্তিত্ব বা রোউল মডেলের কথা।
৮৬ সালে সিলেটের সাপ্তাহিক সমাচার-সম্পাদক আব্দুল ওয়াহিদ খান জেনারেল ওসমানীর জীবন ও কর্ম নিয়ে একখানা গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সম্পাদনার দায়িত্ব আমার উপর অর্পন করেন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে আমি সিলেট ছেড়ে চলে আসায় সম্পাদনার মহৎ কাজটি সম্পন্ন করতে পারিনি। তবে এ সুবাদে জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে জানার জন্যে বহুলোকের সাথে কথা বলেছি এবং তাঁর সম্পর্কে লেখা বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
জেনারেল ওসমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ট একজন বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস তিনি জেনারেল ওসমানীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। জেনারেল ওসমানীর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন পীর, তাঁর নিজ ভাষায় সেইন্ট বা পূতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী। আলোচ্য এ বন্ধুর নাম এ আর চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল। জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে জানার জন্যে আমি তাঁর সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। সিলেট প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হারুনুজ্জামান চৌধুরীর সাথে এ আর চৌধুরীর খাদিম নগরের গ্রিনহিল বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি মুক্তিযুদ্ধ ও জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে। হারুনুজ্জামান চৌধুরী তখন সাপ্তাহিক জালালাবাদের সম্পাদক, অফিস ছিল ধোপাদিঘির পূর্বপার। আমি সেখানে নিয়মিত হাজিরা দিতাম। এ আর চৌধুরী মাঝে মাঝে সেখানে এসে বসতেন। তখন তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম, শুনতাম তাদের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কথা।
জেনারেল ওসমানী অনেকের সাথে আলাপচারিতার সময় মাঝে মাঝে বলতেন, তিনি আত্মকথা লিখছেন। এ নিয়ে সাংবাদিক মহলসহ সকলের মনে খুব কৌতুহল ছিল। তবে খারাপ চরিত্রের লোকেদের মধ্যে ছিল ভয়। জেনারেল ওসমানী কাউকে ছেড়ে কথা বলার লোক নয়, এ কথা কারো অজানা ছিল না। আত্মকথা লেখার সুযোগে তিনি অসৎ বা দুনম্বরী লোকদের চরিত্র সবার সামনে উন্মোচন করে দিবেন ভেবে তারা শঙ্কিত ছিল। ইন্তেকালের পর তাঁর আত্মজীবনীর অন্বেষণ শুরু হয়। অনেক খোঁজাখুজি করেও এর কোন হদিস পওয়া যায়নি। তখন অনেকে বলতে শুরু করেন, কোন দুষ্ট লোক হয়তো আত্মজীবনী লুকিয়ে ফেলেছে।
কর্নেল এ আর চৌধুরীকে আমি এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করি। জবাবে তিনি যা বলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় ওসমানী সাহেব আত্মজীবনী লেখে যাননি। এর কারণ, আত্মজীবনী লেখলে সেখানে তাঁকে অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হতো। অপ্রিয় সত্য বলতে ওসমানী সাহেব ভীত ছিলেন না। তাঁর ভয় ছিল অন্য খানে। আমরা সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের মধ্যে আদর্শ ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুব কম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের সামনে রউল মডেল হিসেবে কিছু মানুষ থাকতে হবে, রাখতে হবে। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা দোষত্রুটির উর্ধে নয়। ওসমানী সাহেবের সত্যকথনের ফলে তরুণদের মনে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা তৈরি হতে পারে যা দেশের ভবিষতের জন্যে ভালো হবে না। দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তিনি আত্মকথা লেখার ইচ্ছা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’ এ আর চৌধুরীর মতে, জেনারেল ওসমানীর মতো দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার জন্যে কাজটা যথাযথ হয়েছে। কারণ জাতীয় নেতাদের চরিত্র হনন কোন দেশের জন্যেই কল্যাণকর নয়।
জেনারেল ওসমানীর আত্মজীবনী সম্পর্কে কর্নেল এ আর চৌধুরীর এ মতের সাথে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। সাংবাদিক ও লেখক ইসহাক কাজলের মতে, জেনারেল ওসমানী আত্মজীবনী লিখে গিয়েছেন। চিকিৎসার জন্যে লন্ডনে আসার সময় তিনি তা লন্ডনে নিয়ে আসেন। তাঁর ইন্তেকালের পর লন্ডন থেকেই তা গায়েব করে দেয়া হয়েছে। কারা গায়েব করে দিয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
ওপরদিকে জেনারেল ওসমানীর ঘনিষ্টজন, জাতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও দফতর সম্পাদক ইকবাল হোসেন চৌধুরীর মতে, জেনারেল ওসমানী তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন এবং তা প্রকাশের ব্যাপারে লন্ডনে অবস্থানকালে বৃটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস এন্ড পাবলিকেশনের সাথে কথাবার্তাও বলেছেন। ইকবাল হোসেন চৌধুরীকে বইটির ভূমিকা পাঠ করার জন্যে জেনারেল ওসমানী নিজে দিয়েছেন। ইকবাল হোসেন চৌধুরী এ ব্যাপারে নিশ্চিত, জেনারেল ওসমানী অসুস্থ অবস্থায় লন্ডন আসার সময় বইটির পা-ুলিপি তাঁর সাথে ছিল না। প্রকাশনা সংস্থার সাথে কথা ছিল, দেশে গিয়ে তিনি আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
জেনারেল ওসমানী তাঁর আত্মজীবনী লিখে গেছেন, এ কথা মেনে নিলেও তাঁর ইন্তেকালের পর তা পাওয়া গেছে বলে কেউ দাবি করেননি। আর কে বা কারা তা গায়েব করেছেন সে ব্যাপারে আমরা অনুমানের উপর নির্ভর করে কথা বলতে পারি, কিন্তু নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে এ কথা বলা যায়, তিনি আত্মজীবনী লিখে থাকলে তা প্রকাশিত হলে যাদের স্বার্থ বা সুনাম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদেরই কেউ তা গায়েব করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর আত্মজীবনী থেকে আমরা শুধু তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতাম না, সেখানে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও রণকৌশল সম্পর্কে নির্ভুল ও বস্তুনিষ্ঠ অনেক অজানা তথ্য পেতাম।
সে যা-ই হোক, ব্যক্তিগত পড়াশোনা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি তা থেকে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বিভিন্ন দিক দিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরার মত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। এ ধরণের ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে খুব কমই আছে। সততা, ন্যায়পরায়নতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থার কারণে তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের কাছে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আমরা যদি তাঁকে মূল্য না দেই বা না দিতে পারি তা হলে তা হবে আমাদের নিজেদের অযোগ্যতা ও দীনতা।
বাংলাদেশে যে রাজনীতি দেখে আমরা অভ্যস্ত সেখানে মন্ত্রীত্ব থেকে কি কেউ পদত্যাগ করে? জেনারেল ওসমানী বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। আমরা আরো দেখি, কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে সেখানে সবাই যে ভাবেই হোক পাশ করতে চায়। বৈধ-অবৈধের প্রশ্ন তখন গৌন হয়ে যায়। কিন্তু জেনারেল ওসমানীর বেলায় আমরা দেখি এক স¤পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এক নির্বাচনের সময় তাঁর কয়েকজন নির্বাচন-কর্মীকে অবৈধ ভোট প্রদানের দায়ে গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়া কর্মীদের মুক্ত করতে গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলে দেন, ওসমানী সাহেব অনুরোধ করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। জেনারেল ওসমানীর কাছে এ খবর পৌঁছলে তিনি ঠিকই থানায় ফোন করেন। ফোন করে তিনি কি বলেন জানেন? তিনি বলে দেন, ‘ওদের কেউ জালভোট দিয়েছে তা প্রমাণিত হলে এ জন্যে যে শাস্তি রয়েছে তা-ই যেন তাদের দেয়া হয়।’ বাংলাদেশে কি এর কোন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবেন?
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বাঙালির ১০টার সভা ১২টায় শুরু হয়, এটা আমরা সবাই জানি। এক নির্বাচনের সময় তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান সকাল ১০ টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল। জেনারেল ওসমানী যথা সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখেন, উদ্যোক্তাদের কেউ তখনো সেখানে আসেননি। তিনি মন খারাপ করে সভাস্থলে বসে থেকে স্থানীয় নেতাদের জন্যে অপেক্ষা করেননি, বরং তখনই সভাস্থল ত্যাগ করে চলে আসেন। উপস্থিত কিছু লোক অনেক অনুরোধ করেও তাঁকে সেখানে ধরে রাখতে পারেননি।
জেনারেল ওসমানীর জীবনে এ রকম অসংখ্য ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তাঁকে মূল্যায়ন করা হয়না, কি তাঁর অপরাধ? কেউ কেউ বলেন কঠোর নীতিনিষ্ঠা ও ¯পষ্টবাদিতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা রাখার পরও তিনি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছেন না। অপর কিছু লোকের মতে আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয় ছেড়ে আসাই তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ কারণেই অওয়ামী লীগের অনেকে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে স্বীকার করতে চায়না। তাদের মতে তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। একজন প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আরো এগিয়ে গিয়ে জেনারেল ওসমানীকে ভীরু ও কাপুরুষ হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ সকল মিথ্যাচার যদি এখন সংশোধন করা না হয় তা হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্ব নিছক নামসর্বস্ব একজন নায়ক হিসেবে বেঁচে থাকবেন।
‘চরমপত্রের’এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থে জেনারেল ওসমানীর ব্যাপারে এমন সব কথা বলেছেন যার সাথে আমাদের পরিচিত জেনারেল ওসমানীর শুধু কোন মিল যে নেই তা নয়, তাঁর ব্যাপারে অন্যান্যদের বর্ণনারও সামঞ্জস্য সেখানে নেই। মনে হয় কোন পূর্বশত্রুতার জের ধরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তিনি জেনারেল ওসমানীর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আব্দুল আজিজ ‘তিনি বিজয় দেখেছেন, ওসমানী দেখেননি’ শিরোনামে তাঁর কথার চমৎকার জবাব দিয়েছেন।
রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানী কেন উপস্থিত ছিলেন না, এ কথা তখন যেমন উত্থাপিত হয়েছে, তেমনি এখনো অনেকের মনে এ ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। এম আর আখতার মুকুলের মতে জেনারেল ওসমানী ভয়ে সেখানে হাজির হননি। যার কারণে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদ বাধ্য হয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে সেখানে পাঠান। তিনটি বড় বড় যুদ্ধে সরাসারি অংশ গ্রহণের গৌরব যার জীবনকে মহিমান্বিত করে রেখেছে তাঁকে ভীরু বা কাপুরুষ বলার মতো হাস্যকর কথা আর হয় না। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র’ ১৫শ খন্ডে জনাব এ কে খোন্দকারের একটি সাক্ষাতকার রয়েছে। সেখানে এ কে খোন্দকার নিজে ¯পষ্টভাবে বলেন, সে সময় ওসমানী সাহেব মুজিব নগরে ছিলেন না বলেই তাকে (এ কে খোন্দকারকে) আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়।
এ স¤পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন-প্রধান এবং সাবেক ¯পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ভিন্ন ধরণের বক্তব্য রেখেছেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ’ গ্রন্থে প্রকাশিত সাক্ষাতকারে তিনি ভারত সরকারের সাথে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের স¤পাদিত গোপন সাত দফা চুক্তির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাঁর বর্ণনা মতে, চুক্তির মধ্যে এ কথা ছিল যে সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনে থাকবে। চুক্তির এ অনুচ্ছেদটির কথা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে জানানো হলে তীব্র ক্ষোভে তিনি ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেননি।
যে যা-ই বলুন না কেন এ ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীর নিজের কথাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজে ভাল করে জানেন কেন তিনি সে অনুষ্ঠানে থাকেননি। তিনি কেন পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, জেনারেল ওসমানীকে বহু সময় এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। ‘একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা’ নামক স্মৃতিকথায় তিনি বলেন, ১৮ ডিসেম্বর রণাঙ্গন থেকে সদর দপ্তরে ফিরে এলে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে নানা কথা শুনে জেনারেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হন। তখন তিনি বলেন,
‘দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ স¤পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান – পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবে অত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের অত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।’
‘নাম্বার টু – ঢাকায় আসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে. জে. অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব। ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই! আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।’
১৯৮০ সালের স্বাধীনতা সংখ্যা রোববারে প্রকাশিত অপর এক সাক্ষাতকারে জেনারেল ওসমানী বলেন, ‘তখন আমি ছিলাম রণাঙ্গন সফরে। তবে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী জানতেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তবু আমাকে কোন খবর দেয়া হয়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে পাঠান আমার ডিপুটি চীফ অব ষ্টাফ তদানীন্তন গ্রুপক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে। উপরোক্ত বাস্তব তথ্য ও পারবর্তী ঘটনাবলী থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মহান ব্যক্তিবর্গ (স্ব স্ব কারণে ও উদ্দেশ্যে) চাইতেন না যে এ আত্মসমর্পণ বাংলাদেশ তথা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের কাছে হোক।’
জেনারেল ওসমানীর এ বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে গেছে, এম আর আখতার মুকুল’র কথা একটা বানানো কথা মাত্র।
জেনারেল ওসমানীর অপরাধ কি যার কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্ব হয়েও সমাদর পাচ্ছেন না ? তাঁর প্রথম অপরাধ হচ্ছে, (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ভাষ্য অনুসারে) ভারতের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স¤পাদিত সাতদফা গোপন চুক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করা। দ্বিতীয়তঃ ১৯৭৪ সালের মে মাসে চিঠি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করা এবং পরবর্তীতে সে চিঠি প্রকাশ করে দেয়া। তৃতীয়তঃ বাকশাল তথা একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদ থেকে এ বলে পদত্যাগ করা যে ‘চতুর্থ সংশোধনীর অর্থ হল জনগণের সাথে প্রতারণা করা।’
উল্লেখ্য, বিশ্বত্বসূত্র মতে জেনারেল ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগ দেন বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে। তখনই তিনি গণনীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে শর্ত দেন এবং বঙ্গবন্ধু তা মেনে নেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ৭০’র নির্বাচনে তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তাঁর চতুর্থ অপরাধ অপেক্ষাকৃত গুরুতর। ৭৫’র পটপরিবর্তনের পর বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে খোন্দকার মোশতাককে তিনি শুরুর দিকে কিছুটা সহযোগিতা প্রদান করেন। খোন্দকার মোশতাক তাঁকে প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে যখন খোন্দকার মোশতাক সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তখন জেনারেল ওসমানী শপথ না নিয়ে অবৈতনিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনে সম্মত হন। আসলে জেনারেল ওসমানী তখন খোন্দকার মোশতাককে সহযোগিতা নয়, জাতীয় সংকট মুহূর্তে জাতিকে সেবা প্রদান করেছেন। তখন সেনাবহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল এবং তা পুনঃস্থাপনে জেনারেল ওসমানীর সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। পরে জেলহত্যার প্রতিবাদে তিনি খোন্দকার মোশতাকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও তিনি একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন জাতীয় সংকট মুহুর্তে তাঁর ভূমিকা স¤পর্কে শুধু তারাই প্রশ্ন তুলতে পারে যাদের বোচকা বা দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে ওঠে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে।
জেনারেল ওসমানী সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদ ছিলেন না। চাটুকারিতা ও কপটতাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। রাজনীতি বলতে তিনি গণনীতি বুঝতেন। রাজনীতি তাঁর পেশা ছিলনা। লুটপাট সমিতির যারা সদস্য তারা তাঁর কাছে যেতেই ভয় পেতো। তার সততা, ন্যায়নিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার ছিল তুলনাহীন। জেনারেল ওসমানীর আসল এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ এটাই। জেনারেল ওসমানীর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সামনে লুটেরা ও ধোকাবাজরা নিস্প্রভ হয়ে পড়বে, এ ভয় থেকেই তাঁকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের শিশু-কিশোর এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মতো উন্নত চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিত্বের খুব অভাব। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সৎ এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জেনারেল ওসমানীর জীবনের বিভিন্ন দিক বার বার তাদের সামনে উপস্থাপন করা দরকার বলে আমরা মনে করি।