ইউকে সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

রমজানের মনোবেদনা

অলিউল্লাহ নোমান: রমজান মাস এলেই মনটা ছটপট করে। বিশেষ করে ৩টি বিষয় মনকে বেশি নাড়া দেয়।

(এক) ছাত্র জীবনে পুরো রমজান মাস অতিবাহিত হত কোরআন শরীফ নিয়ে। চাকুরি জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে সেই সুযোগ আর পাইনি। জীবীকার তাগিদে কর্ম ব্যস্ততায় সময় কাটে এখন।
(দুই) ২০১০ সালের রমজানেই সুপ্রিমকোর্টের এক রায়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল।

(তিন) ২০১৪ সালের ৭ রমজান আমার আম্মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি আম্মার শেষ বিদায়ে কাছে থাকতে পারিনি।
রমজানের শুরু থেকেই মনটা মা’র জন্য বেশি কেঁদে উঠে। মাঝে মধ্যেই নিজের অজান্তে চোখের পানি চলে আসে।

আজ ৬ষ্ঠ রোজা। ২০১০ সালের এই দিনেই সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল। রায়ে বলা হলো আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারা কতৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করতে। রায় শুনে আম্মা ফোন করেছিলেন। ফোনে শুধু কাঁদলেন।

কত দিনের মধ্যে আত্মসর্ম্পন করা লাগবে সেটা স্পষ্ট বলা ছিল না রায়ে। সিনিয়র আইনজীবীরা বললেন, সময় উল্লেখ না থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পন করতে হবে। তাই সপ্তাহের শেষ দিন হিসাবে কষে ১৩ রমজান আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুতি নিলাম।

ফ্যাসিবাদ আওয়ামী-বাম সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রথমে আদালতকে পুরো নিয়ন্ত্রনে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। আদালত সরকারি নিয়েন্ত্রণে নেয়ার প্রতিটি ধাপে ধাপে রিপোর্ট করতে লাগলাম। দৈনিক আমার দেশ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল কিভাবে আদালতকে কব্জায় নিচ্ছে সরকার। তখন এতে কেউ সায় দেয়নি। মাঝে মধ্যে আমার কোন কোন লেখায় কেউ উত্তেজিত হয়ে কমেন্টস করতে দেখি “আপনি কি করেছেন!?” তখন চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার পাতা গুলে একটু উল্টিয়ে দেখে নেন। না, এটা বলি না। ধৈর্য্য ধারন করে জবাব দেয়া থেকে এড়িয়ে যাই। কোন একজন জ্ঞানী লোক বলেছিলেন, অবান্তর কথার জবাব না দেয়াটাই হচ্ছে বড় প্রতিবাদ।

যাক, ফিরে আসি সুপ্রিমকোর্টের রায়ে। কেন সেই রায়!! সরকার আদালতকে কব্জায় নিচ্ছে। সম্পাদক মহোদয় বললেন, সরকাকে সহায়তা করছে আদালত। এনিয়ে তোমরা রিপোর্ট দেখি না কেন? ভয় পাওয়া নাকি! বললাম, আদালত অবমাননা বলে একটা আইন আছে। তিনি বললেন, জেলে যাওয়ার ভয় থাকলে সাংবাদিকতা করতে আসা ঠিক হয়নি। সত্য লিখতে হবে। আমিও তখন বললাম, আপনার জেলে যেতে সমস্যা না হলে, আমারও কোন সমস্যা নেই। তিনিও বললেন, কোন সমস্যা নেই। সত্য প্রকাশ করে জেলে যেতে হলে যাব। তোমাদের সমস্যা না হলে লিখে যাও।
সাধারণত আদালতের বিষয় নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা হয় না। কারন, কথায় কথায় আদালত অবমাননার স্যূয়মোট রুল ইস্যু করে।

সম্পাদক মহোদয়ের কথায় মনে সাহস পেলাম। শুরু করলাম বিভিন্ন ইস্যুতে রিপোর্ট লেখা। একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল শেখ হেলালকে বিশেষ সহায়তা দিয়েছে মোজাম্মেল হোসেনের বেঞ্চ। এরপরই অনেকে বলেছিলেন, আপনার খবর আছে। পরবর্তী রিপোর্ট লিখলাম, খুনের মামলার প্রধান আসামী ও সুপ্রিমকোর্টে তান্ডবে নেতৃত্বদানকারী সন্ত্রাসীও বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। আমার রিপোর্টের প্রেক্ষিতেই দুই জনের শপথ দেননি তখন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম। ৬ মাস পর ফজলুল করিম অবসরে গেলে প্রধান বিচারপতি হন খায়রুল হক। তিনি এসে নিয়োগের ৭ মাস পর তাদের শপথ দিলেন।

তারপর লিখলাম, ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে বিশেষ রিপোর্ট। এরকম একের পর এক রিপোর্ট লিখতে থাকলাম। কারো টনক নড়ে না। আজ যারা বলেন, আমরা কি করেছি? সেই গোত্রের অনেককেই বলতে শুনেছি তখন, আমার দেশ বেশি বাড়াবাড়ি করছে! ৫ বছর পর আওয়ামী লীগ এমনিতেই চলে যাবে। তখন এসব ঝেটিয়ে বিদায় করা যাবে। এখনই সরকারের শুরুতে আমার দেশ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। সরকারকে আরো সময় দিলে তারা এমনিতেই পচে যাবে। ৫ বছর পর আর খুজে পাওয়া যাবে না। তখন এসব লেখা যেত। এরকম কত কথা এ গোত্রীয় জাতীয়তাবাদীদের মুখে শুনেছি!
যাক, শেষ পর্যন্ত উল্টা সুপ্রিমকোর্টের টনক নড়ে উঠে। আদালত অবমাননার সমন দিয়ে আমাদের তলব করা হল আপিল বিভাগে। প্রধান বিচারপতি (!) মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে গঠিত ৬ বিচারপতির বেঞ্চে উপস্থিত হতে হবে। যথারীতি শুনানী শুরু হয়। এর মধ্যে অনেক নাটকীয়তা ঘটে। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক তখন কারাগারে ছিলেন। কারাগারে সমন পাঠিয়ে তাঁকে সুপ্রিমকোর্টে নিয়মিত হাজির করার ব্যবস্থা করা হল। রিপোর্টের লেখক হিসাবে আমাকেও হাজিরা দিতে হয়। টানা ৩ কার্য দিবসে শুনানী হয় আপিল বিভাগে। কোন আইনজীবী রাজি হলেন না, আপিল বিভাগে আমাদের পক্ষে শুনানী করার জন্য। কারন আদালত অবমাননার অভিযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্ষমতা চাওয়া হয়। কিন্তু, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক অনঢ়। তিনি বললেন, আমার রিপোর্টর অসত্য কিছু লিখেনি। আমার দেশ অসত্য কিছু প্রকাশ করেনি। তাই ক্ষমতা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এতে আমাদের পক্ষের সকল সিনিয়র আইনজীবী জানিয়ে দিলেন তারা শুনানী করতে অপারাগ। কারন, প্রতিদিন এই আদালতের কাছেই তাদেরকে মামলা নিয়ে আসতে হয়। সুতরাং আদালতের বিরুদ্ধে তারা দাড়াতে পারবেন না।

কি আর করা। কারাগারে সম্পাদক মহোদয়ের কাছে এ খবর পৌছানো হল। তিনি বললেন, নিজেই শুনানী করবেন। তিনি নিজেই শুনানী করলেন। প্রথম দিন ৬ বিচারপতির প্রশ্নবানে মুখেও দৃঢ়তার সাথে সব জবাব দিলেন। বিচারকরা প্রসঙ্গের বাইরে গিয়েও তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমন করে প্রশ্ন ছোড়ে দেন। এক পর্যায়ে খায়রুল হক বলে উঠেন, আপনি তো চান্স সম্পাদক। এর জবাবে পরের দিনের শুনানীতে আমরা ১২জন প্রথিতযশা সম্পাদকের তালিকা দিলাম আদালতকে। দেখিয়ে দিলাম, দৈনিক ইত্তেফাকের মানিক মিয়া থেকে শুরু করে অবজাভারের বিখ্যাত সম্পাদক আবদুল সালাম সকলেই সরকারি চাকুরে ছিলেন। তারাও সময় সুযোগে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেছেন। সুতরাং ‘চান্স সম্পাদক’ একথা বলা অবান্তর। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আদালতে চাকুরি করতেন। আবদুস সালাম ছিলেন, পরিকস্তান সরকারের সচিব। অবসরের পর তারা সাংবাদিকতায় যোগ দেন। এরকম অনেক বিখ্যাত সম্পাদক ও সাংবাদিক সরকারি চাকুরি থেকে অবসরের পর সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন।

এক পর্যায়ে সম্পাদক মহোদয় আমার রিপোর্টের পক্ষে কিছু প্রমান হাজির করলেন। ৬ বিচাপতির বেঞ্চ বলে উঠলেন, ‘এখানে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। উপস্থিতি আইনজীবীদের কেউ প্রতিবাদ করলেন না। পরের দিন রিপোর্ট হয়েছে পত্রিকায়। তা দেখেও কোন রাজনীতিককে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। কিন্তু এখন যখন বলেন, আপনারা কিছ করছেন? তখন এসব বিষয় গুলো মনে পড়ে! সেদিন প্রতিবাদ করলে, আদালতের মাধ্যমে সরকার এতদূর যেতে পারত বলে মনে হয় না। বরং তখন উল্টা বলা হয়েছে, আমার দেশ বাড়াবাড়ি করছে!

সব শেষে রায় ঘোষণার পালা। সম্পাদক মহোদয়কে আইনের সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদন্ড এবং আইনের উর্ধ্বে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আমাকে ৬ সপ্তাহের কারাদন্ড এবং আইনের উধের্¦ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হল। জরিমানা অনাদায়ে সম্পদাক মহোদয়কে আরো একমাস এবং আমাকে আরো এক সপ্তাহ কারাভোগ করতে হবে। আমরা কেউ অন্যায় রায়ের জরিমানা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রতিবাদ স্বরুপ উভয়ে অতিরিক্ত কারাভোগ করেছি। আইনের উর্ধ্বে জরিমানা এজন্যই বললাম, বিদ্ধমান আদালত অবমাননা আইনে বলা ছিল, অনধিক ৬ মাসের কারাদন্ড এবং অনধিক ২ হাজার টাকা জরিমানা। অর্থাৎ ৬ মাসের উপরে এবং ২ হাজার টাকার বেশি জরিমানা করার সুযোগ আইনে নেই। অথচ তারা একজনকে ১ লাখ আরেকজনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করলেন। পরবর্তীতে রায়ে ব্যাখ্যায় বলা হল, আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় এই দন্ড দেয়া হয়েছে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ রমজান আমাকে কারাগারে পৌছে দেন সহকর্মী, সিনিয়র সাংবাদিক, আইনজীবী ও শুভাকাঙ্খিরা। শুরু হয় রমজানে কারাজীবন। ২০১০ সালে ১৩ রমজান থেকে বাকী রোজা গুলো কারাগারেই পালন করেছি। এক বিরল অভিজ্ঞতা। সেহরী, ইফতার, তারাবী সবই কারাগারে। সন্ধ্যায় প্রতিটি রুম তালা দেয়া হয়। খুবই অসহায় লাগত নিজেকে। তালাবন্দি রুমে বসবাস! তাই কারাগারে বড় জমায়েতে তারাবি পড়ার সুযোগ নেই। রুমে যারা থাকেন তারাই মিলে মিশে তারাবি আদায় করেন। আমার রুমে ছিলাম ৪ জন। ১৪ রমজান থেকে আমার উপর বর্তায় ইমামতির দায়িত্ব।

ঈদের দিন সকালে প্রস্তুতি নিচ্ছি ঈদ জমায়েতে শরীক হব। হঠাৎ করেই কারা কতৃপক্ষের একজন এসে বললেন, আপনি আমার সাথে যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে! বললেন, উপরের নির্দেশ রয়েছে ২৬ সেলে যেতে হবে আপনাকে। মানে ডিভিশন প্রাপ্ত বন্দিদের সেলে। তাঁর সাথে গেলাম। বলা হল, আপনি এখানে ঈদের জমায়েত আদায় করবেন। এ ভবনে আরো গিয়েছি। তবে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য। আমার সেলের পাশেই এ ভবন। ওইদিন এখানে ছিলেন, জমায়েতে ইসলামীর সাবেক আমির শহীদ মাওলানা মতিউর হমান নিজামী, জমায়েতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মুজাহিদ, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদী, বিএনপি নেতা আবদুল সালাম পিন্টু, সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক আলোচিত ওসমান গণি, পিজি হাসপাতলের একজন ডাক্তার, ব্যবসায়ী আজম রেজা চৌধুরী ও সাবেক ওসি রফিকুল ইসলাম। শেষের দুইজন এই ভবনের জন্য আইন অনুযায়ী এনটাইটেল ছিলেন না। তদবীর বা টাকার জোরে তারা ডিভিশনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। জেল থেকে বের হয়ে সিরিজ রিপোর্টে বিষয় গুলো উল্লেখ করেছিলাম। এরপরই শেষের দুইজনকে ডিভিশন সেল থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ফিরে আসতে চাই ঈদের দিনে অভিজ্ঞতায়। ভবনের বারান্দায় আমরা ১৩ জন মিলে নামাজ আদায় করলাম। ইমামতি করলেন, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদী। নামাজ শেষে ফিরে আসতে চাইলাম। কারন পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল কয়েক জানের সাথে পুরো কারাগার ঘুরব। ঈদের দিনই একমাত্র সুযোগ অবাধে পুরো কারাগার দেখা। নতুবা নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক সেল বা ওয়ার্ড থেকে আরেক সেলে বা ওয়ার্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বিদায় নিতে চাইলেই শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বললেন, মেহমানকে যেতে দিবেন না। আমাদের এখানে রান্নাবান্না হয়েছে। ওনি খেয়ে যাবেন। নাছোরবান্দা তিনি। কোন অবস্থায়ই আমাকে ফিরতে দিলেন না। আমার তাড়া দেখে দ্রুত খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করলেন তিনি নিজেই। এখানে উল্লেখ্য, ডিভিশন সেলে নিজেদের উদ্যোগে রান্নার সুযোগ রয়েছে। যা অন্য বন্দিদের বেলায় নেই।
সেই দিনের দুইজন রাজনীতিক সহ সাজানো বিচারে আরো যাদের নাম শহীদের তালিকাভুক্ত হয়েছে, আল্লাহ তাদের সংগ্রামকে কবুল করুন। এই রমজানে আমাদের রোজার পূর্ন সাওয়াব দান করুন।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ