
আমার সাথে রবী দা’র সম্পর্কটা বেশ পুরনো। রবী দা’র সাথে আমার প্রথম দেখা হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজে ১৯১৯ সালের ৭ নভেম্বর। তখন রবী দা’র বয়স ৫৮ আর আমি তখন মাত্র যৌবনে পা দিয়েছি। রবী দা এমসি কলেজে আসার পর ছাত্রাবাসে আমরা একটা সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। সে সংবর্ধনা সভায় তিনি ‘আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেছ? কী শিখতে হবে ভেবে দেখো। পাখি তার বাপ-মায়ের কাছে কী শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কী করে বড় করে আকাঙ্ক্ষা করতে হয়।’রবী দা‘র কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিলো। তৎকালীন কলেজ প্রিন্সিপাল মহোদয়ের অনুমতিক্রমে আমি একটি ইন্টারভিউ করেছিলাম রবী দা’র। অনেক আগের করা ইন্টারভিউ; আপনাদের সুবিধার্থে তুলে ধরলাম নির্বাচিত কিছু অংশ।
আজহার উদ্দিন শিমুল: এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আসতে পেরে কেমন লাগছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: অনেক ভালো লাগছে। চারদিকে সবুজ অরণ্য আমার ভালো লাগে। এই পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখানের ছাত্ররা আমাকে যে যত্ন করলো তা আমার আজীবন স্মৃতিপটে থাকবে।
আজহার উদ্দিন শিমুল: ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: আমরা আন্দোলন তো করেই যাচ্ছি। আমরা আরও একত্ম হলেও ব্রিটিশরা আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হবে। আমরা ব্রিটিশদের শেকল ভাঙবোই।
আজহার উদ্দিন শিমুল: আপনি তো মাত্র ৬ বছর আগে বাংলা সাহিত্যে প্রথম বাঙালি হিসেবে নোবেল পেলেন, বিষয়টা আপনাকে কতটুকু আনন্দিত করেছিলো?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ১৫ নভেম্বর ১৯১৩ সালে আমার নোবেলপ্রাপ্তির খবর শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছে। ‘একদিন সকালে শান্তিনিকেতনের ছাত্ররা রান্নাঘরে খেতে বসেছে, এমন সময় অজিতকুমার চক্রবর্তী উচ্ছ্বাসে ছুটে এসে বললেন, আপনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন! তখনই আমি মূলত শুনেছি। আমি নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য ১৯১৩ সালে সুইডেনে যাই নি। আমার পক্ষে স্টকহোমে ব্রিটিশ দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান চার্লস পুরস্কার গ্রহণ করেন।
আজহার উদ্দিন শিমুল: আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারাটি অত্যন্ত জটিল। আমি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করি। আপনি যদি ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা পড়েন তাহলে আমার প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাবেন।
আজহার উদ্দিন শিমুল: আপনি তো ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। আপনার ভ্রমণ প্রিয়তা নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সুন্দর প্রশ্ন করেছেন, শিমুল। দেখুন আমি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর সারা বিশ্ব আমার ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। অধিকাংশ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছি আমি ; জাহাজযোগে বহু দেশে গিয়েছি এবং তা এখনো অব্যাহত আছে ; পরিচিত হয়েছি বিভিন্ন দেশের বিদ্যজন ও রাজ-রাজড়াদের সাথে। বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি। আমার জীবনোপলব্ধি ও দর্শন এবং কাব্যের মর্মবাণী আমি সরাসরি বিশ্বমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। ১৮৭৮ থেকে আমি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছি। তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর। দেশগুলো হলোঃ ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, ডেনমার্ক, সুইডেন ইত্যাদি। আমি দ্বিতীয় লণ্ডন ভ্রমণে ১৮৯০ সালে যাই। ১৯১২ সালের ২৭ মে আমি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণে বের হই। সঙ্গে ছিল নিজের একগুচ্ছ রচনার ইংরেজি অনুবাদ। লন্ডনে মিশনারি তথা গান্ধীবাদী চার্লস এফ. অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রাইস, টমাস স্টার্জ মুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আমার গুণমুগ্ধে পরিণত হন। যুক্তরাজ্যে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের বাটারটনে অ্যান্ড্রুজের ধর্মযাজক বন্ধুদের সঙ্গে কিছুদিন অতিবাহিত করি আমি। ১৯১৬ সালের ৩ মে থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছি।
আজহার উদ্দিন শিমুল: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: আপনাকেও।
ইন্টারভিউ শেষ করে আমাকে তাঁর লেখা কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়ে শোনালেন। আমি বরাবরই তার কবিতা ও গানের প্রেমিক। ইন্টারভিউ শেষ করার পর রবী দাকে বলেছিলাম, ‘দাদা, আমাকে নিয়ে একটা ভবিষ্যৎ বাণী করেন তো’?
তিনি তখন মুচকি হেসে বলেছিলেন ,আমি এসব করি না। কর্মে বড়ো হও, কর্মই তোমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিবে।
রবী দা‘র এই কথার পর আমি আমার কর্মের প্রতি মনোযোগী হই। এখনো প্রায়ই মধ্যরাতে রবী দা’র কথাগুলো মনে পড়ে।
আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে ; কারণ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। জন্মবার্ষিকীতে অনেক শ্রদ্ধা। ভালো থাকুন দাদা।
বি:দ্র: ইন্টারভিউটি কাল্পনিক! ছবিটি কলকাতার মাদার’স ওয়াক্স মিউজিয়ামে ২০১৮ সালে উঠানো।
লেখক: আজহার উদ্দিন শিমুল, এমসি কলেজ, সিলেট