
সেলিম আউয়াল: একসময় সিলেটের ফটো স্টুডিওতে শাদা কালো ছবি প্রিন্ট হতো, তাও হাত দিয়ে। ডার্করুম নামের আলোবাতাসহীন অন্ধকার ছোট্ট একটি রুমে ঘন্টার পর ঘন্টা অবস্থান করে ছবি প্রিন্টের কথা আজকালকার অনেকে ভাবতেই পারবে না। তখন কোনো কোনো স্টুডিওতে ছবি রঙ্গিন করা হতো। মানে শাদা কালো ফটোতে রং দেয়া হতো। ঠোটে ঠোটের রং, মুখে অন্য ধরনের রং, পরনের কাপড়ের রং ইত্যাদি দিয়ে ফটোকে রঙ্গিন করা হতো। সাংবাদিক এডভোকেট তাজউদ্দিনের এ ব্যাপারে অভিমত নগরীর সুরমা মার্কেটের পিয়া ফটো স্টুডিও শাদাকালো ছবিকে রং-তুলি দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিতো ছিলো পারদর্শী, ছবি রাঙ্গাতে প্রতিষ্ঠানটি ছিলো পাইওনিয়ার। পিয়া স্টুডিও’র মালিক ছিলেন ইমরান হোসেন, তার ডাক নাম ছিলো কাঁচা মিয়া।
স্বাধীনতার বেশ কয়েকবছর পর সিলেটে রঙ্গিন ফিল্ম দিয়ে রঙ্গিন ছবি তোলা শুরু হয়। লোকজনও লুফে নেয় রঙ্গিন ছবি। এ নিয়ে সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক ডাইরেক্টর মোহাম্মদ লায়েস উদ্দিনের বক্তব্যকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করছি। তিনি ফেইসবুকে অত্র লেখার অংশ বিশেষ পাঠ করে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনিও স্বীকার করেন সিলেটে হাউজিং এস্টেটে ‘হংকং কালার ল্যাব’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রঙ্গিন ফটোর ব্যবসা শুরু করে। প্রথমদিকে তারা গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে ঢাকা থেকে ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনতো। তখন একটি ছবির প্রিন্ট গ্রাহকের হাতে সময় লেগে যেতো ৭/৮দিন। পরে প্রতিষ্ঠানটি সিলেটেও ম্যানুয়েলি ছবি প্রিন্টের ব্যবস্থা করেছিলো। এরপর আরো অনেকে সিলেটে ম্যানুয়েলি রঙ্গিন ছবি প্রিন্টের ব্যবস্থা করেন। লায়েস উদ্দিনের তথ্য হচ্ছেÑসিলেটে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে কালার ছবি প্রিন্ট শুরু হয়। তার মালিকানাধীন জিন্দাবাজারের মেগা কালার ল্যাব সিলেটে ডিজিটাল ফটো প্রিন্ট প্রযুক্তি চালু করে। ঢাকার বাইরে এটি ছিলো পুরো বাংলাদেশের একমাত্র কালার ল্যাব। ঢাকায় প্রথম ডিজিটাল ল্যাব করেছিলেন আনিস আহমদ গোর্কি, মালিবাগ মোড়ে ছিলো দেশের দ্বিতীয় কালার ল্যাব। তৃতীয়টি আকিজ গ্রুপ চালু করেছিলো স্পন্দন নাম দিয়ে। এরপরই সিলেটে মেগা কালার ল্যাবের গোড়াপত্তন। সিলেটের পর যশোরের দড়া টানা মোড়ে সেই আকিজ গ্রুপ আরেকটি ডিজিটাল ল্যাব চালু করে।
ধীরে ধীরে এইভাবে সিলেট শহরে ফুজি, কোডাক, কনিকা প্রভৃতি কোম্পানির আধুনিক ল্যাব চালু হয়। পুরনো দিনের সেই সব স্টুডিও-র অনেকগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না চলে যায় বিস্মৃতির অতলে। আজকের কোর্টপয়েন্ট হাসান মার্কেটের পশ্চিমদিকের লাইনে ছিলো সারবাধা ফটো স্টুডিও। প্রতিটি স্টুডিওর সামনে সাজানো থাকতো নিজেদের তোলা অথবা সংগ্রহ করা বড়ো বড়ো ফটো। প্রতিটি স্টুডিও সামনে দেখা যেতো বৈদ্যুতিক লাইট বসানো এক ধরনের বক্স নিয়ে একজন বসে আছেন। তিনি প্রায় দুই ইঞ্চি স্কোয়ার সাইজের নেগেটিভের নীচে লাইট জ্বালিয়ে নেগেটিভ পরীক্ষা করছেন। নেগেটিভের কোথাও সাদা ধরনের কোন দাগ দেখা গেলে কাঠ পেন্সিল দিয়ে ঘসে সাদা দাগকে কালো করে দিচ্ছেন। তারা বলতেন রিটাচ দেয়া। স্টুডিওর অভিজ্ঞ লোকেরাই টাচের এই কাজটা করতেন। তারপরই একটি ছোট্ট দরজা ঠেলে ফটো তোলার স্টুডিও। প্রতিটি স্টুডিওতে থাকতো একটি ড্রেসিং টেবিল। চুল আচড়ানোর ব্যবস্থা। মুখে গলায় মাখার ট্যালকম পাউডার। আর অনেকগুলো টাই, কোট, সানগ্লাস, সংযোগবিহীন টেলিফোন সেট। স্টুডিওর তিনটি দেয়াল জুড়ে থাকতো তিনটি বিশাল আকারের ছবি। একটি কমন ছবি ছিলো তাজমহল। আর ছিলো দেশ-বিদেশের কোন বিখ্যাত স্থাপনার ছবি। আগ্রহী লোকজন মুখে-গলায় স্টুডিও’র ট্যালকম পাউডার মেখে, কোট পরে, গলায় টাই ঝুলিয়ে দেয়ালের দালানগুলো পেছনে রেখে ছবি তুলতেন, ভাবখানা তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। কেউবা টেলিফোন সেটটা কানে লাগিয়ে কথা বলার ভঙ্গিতে ছবি তুলতেন, মনে রাখতে হবে তখন তো টেলিফোন সেট আজকের মতো এতো সহজলভ্য ছিলো না। কোন কোন স্টুডিওতে ম্যানহাইট সাইজের নায়িকাদের ছবি আঁকা থাকতো। প্রিয় নায়িকার একদম কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বন্ধুদের চমকে দেবার সেই উত্তাপটা অনুভব করুন।