ইউকে সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
হেডলাইন

দেশের প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্রন্দন করে ‎দায়মুক্তি পাবেন না ‎


ফরীদ আহমদ রেজা: ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ‎ঘটনায় গোটা বাংলাদেশের সকল মানুষ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। দেশবাসীর সাথে মিলে ‎বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নুসরাতের জন্যে ক্রন্দন করেছেন। অতীতে ‎আরো বহু নিহত ও আহত নারীশিশুর জন্যে শেখ হাসিনা ক্রন্দন করেছেন। মা-বোনেরা ‎দুঃখ পেলে কাঁদবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শেখ হাসিনা শুধু মা-বোন নয়, তিনি ‎বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও। অর্জনের গৌরব যেমন তাঁর তেমনি তাঁকে নিন্দার দায়ও গ্রহণ করতে হবে।

শোনা যায়, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার যখন ছিল তখন সোনাগাজী ‎মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং নুসরাত হত্যার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত সিরাজ উদদৌলা ‎তাদের সাথে ছিলেন। বর্তমানে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ‎আছেন। লুটেরা, ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা এভাবে সবসময় ক্ষমতার মধুভাণ্ডের ‎অন্বেষণে থাকে। দুঃখজনক হলেও এটাই বাংলাদেশের ইতিহাস।

নুসরাতের মা তাঁর মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার ‎বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছিলেন। এটা অনেক বড় ঘটনা হওয়ায় সেই মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে ‎পাঠায়। কিন্তু জেলখানায় বসে তিনি নুসরাতকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ ‎করেন। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। ‎৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে ‎সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে কৌশলে ‎একটি বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার গায়ে দাহ্য পদার্থ ‎দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ‎ইউনিটে নুসরাত মারা যান। ‎

নুসরাতের গায়ে যখন আগুন দেয়া হয়, তখন সিরাজ উদ্দৌলা কারাগারে থাকলেও ‎এর মূল হোতা তিনি। কিন্তু এর দায় আমাদের আরো অনেকের আছে। যে চারজন নুসরাতের গায়ে ‎আগুন দিয়েছে, যারা আগুন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে, যারা সিরাজ উদ্দৌলার মুক্তি ‎চেয়ে মিছিল করেছে তাদের সবারই দায় আছে। পুলিশ, প্রশাসন, গণমাধ্যম, সরকার ‎এবং সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীও দায়মুক্ত নহেন।

নুসরাতের উপর যৌন হয়রানী আজ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নুসরাত দাখিল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ‎ফেরার পথে মামলার ‎অন্যতম আসামী নুরউদ্দিন চুন ছুঁড়ে তাঁর মুখ ঝলসে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। নুসরাতের ‎অপরাধ ছিল নুরউদ্দিনের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়া। সে ঘটনায় নুরউদ্দিনের ‎সাজা হয়নি। পরে সিরাজ উদ্দৌলা যখন মাদ্রাসায় নুসরাতের গায়ে হাত দেয়, তখন ‎তার মায়ের মামলায় প্রিন্সিপালকে গ্রেপ্তার করা হয়। নুরউদ্দিন তখন সিরাজ ‎উদ্দৌলার মুক্তি পরিষদ গঠন করে মানববন্ধন ও মিছিল করে।

সিরাজ উদ্দৌলা নুসরাতের শ্লীলতাহানী করেছে ২৭ মার্চ, আর তার অনুসারীরা ‎নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে ৬ এপ্রিল। এই ১১ দিন সিরাজউদ্দৌলার পালিত ‎সন্ত্রাসীরা নুসরাতের ওপর, তার পরিবারের ওপর মামলা প্রত্যাহারের জন্যে প্রবল ‎চাপ দিয়েছে। নুরউদ্দিনরা যেভাবে আন্দোলন করছিল, তাতে সিরাজউদ্দৌলা হয়তো ‎এক সময় জামিন পেয়ে যেতো। ‎

বাংলাদেশে বিচার চাইতে গেলে কী হয় সেটাও আমরা এ ঘটনায় দেখেছি। ‎সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতসহ অনেকেই মাদ্রাসার সভাপতি ও ফেনীর ‎অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এনামুল করিমের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। ‎সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম অভিযোগ জিজ্ঞাসাবাদের নামে পূনরায় নুসরাতের ‎শ্লীলতাহানী করেছে। বেআইনীভাবে ভিডিও করে তা ফেসবুকে প্রচার করেছে। ‎নুসরাত যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তখন ওসি মোয়াজ্জেম সেটাকে ‎আত্মহত্যার চেষ্টা বলে চাপা দেয়া এবং সিরাজ উদ্দৌলা ঘটনাস্থলে ছিল না বলে ‎তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা ‎আইনে মামলা হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু শেখ ‎হাসিনার নিরাপত্তার জন্যে, সে কারণে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি ‎‎(?)। ওসি মোয়াজ্জেমকে ক্লোজ করা হয়েছে। ক্লোজ করা আসলে কোনো শাস্তি নয়। ‎এ সময়টাতে ওসি মোয়াজ্জেম দায়িত্বমুক্ত থেকে নিজেকে রক্ষা এবং পদন্নোতির (?) ‎জন্যে জোরেশোরে তদবির করতে পারবে। ‎

আজ সারাদেশ নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ছুঁড়ে মারার অপরাধে ‎২০১৭ সালে নুরউদ্দিনের বিচার হলে ঘটনা এতােদূর গড়াতো না। ‎অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে আগেও যৌন হয়রানি ও চেক জালিয়াতির অভিযোগ ‎ছিল। তখনই যদি তার বিচার হতো, তাহলে এখন তার লালসার আগুনে প্রাণ দিতে ‎হতো না নুসরাতকে।

শেখ হাসিনা প্রায়ই ইসলামের কথা বলেন। ‘দূর ফোরাতের পারে একটি কুকুরও ‎যদি না খেয়ে মারা যায় তা হলে আমি ওমরকে এ জন্যে জবাবদিহি করতে হবে’, এ ‎উক্তি তাঁর অবশ্যই জানা আছে। নুসরাত হত্যার জন্যে দায়ী সিরাজ, নুর উদ্দিন, ওসি ‎মোয়াজ্জাম, জেলা প্রশাসক এনামুল করিম, বশংবদ সাংবাদিক – এরা সকলই ‎প্রধানমন্ত্রীর অনুগত গডফাদারদের দ্বারা লালিত-পালিত ও আশ্রিত। নিকট অতীতে ‎তনু, রাফিয়া, মিতু, সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ‎এগুলোর একটিরও এযাবৎ বিচার হয়নি। ওপরদিকে ডিজিটাল আইন, ক্রসফায়ার ও ‎গুম আতঙ্ক নিয়ে দেশবাসীর দিন কাটছে। দেশে হত্যা, বিচারহীনতা ও নির্যাতনের ‎যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, শেখ হাসিনা শুধু ক্রন্দন করে তা থেকে দায়মুক্তি পাবেন ‎না। ‎

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন :

সর্বশেষ সংবাদ