|| রাজনীন ফারজানা ||
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- ব্যালান্স ফর বেটার বা সমতাই ভালো। অর্থাৎ চাকরির বোর্ডরুম, সরকারব্যবস্থা, মিডিয়ায় নারীর উপস্থাপন, কর্মস্থল, সম্পত্তির অধিকার, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান সবক্ষেত্রেই যেন সমতা বজায় থাকে।
প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অর্জন উদযাপনের পাশাপাশি সমাজে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টা মনে করিয়ে দেয়। ১৬২ বছর আগে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা ঠিক করা ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১০ সালে ১৭ টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধির অংশগ্রহণে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয়বারের মত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই ক্লারা পরের বছর থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ৮ মার্চ তারিখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। অনেকেই মনে করেন নারীরা যেহেতু সামগ্রিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন তাই নারী দিবস উদযাপন কতটা প্রয়োজন এই সময়ে এসে।
এমন অবস্থায় নারী দিবস আসলেই কতটা প্রাসঙ্গিক তা এ বিষয়ে কথা হল কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং নারী নেত্রী আয়েশা খানমের সঙ্গে।
আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, প্রতিবছর শুধু নারী দিবসই নয়, আরও অনেক দিবসই উদযাপিত হয়। এসব দিবস যে খুব একটা ফলপ্রসূ হয় তা না। তেমনি একদিন নারী দিবস পালন করলেই যে নারীরা এগিয়ে যাবেন তা না। তবে সমাজে নারীদের সমঅধিকার অর্জনের জন্য সচেতনতা তৈরিতে এমন দিবস প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, নারী দিবস একটা স্লোগান যে স্লোগান নারীদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে ও সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জাগায়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর নারী দিবস নারীদের হাজার বছর ধরে বঞ্চনার ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে। এভাবে নারী ও পুরুষ উভয়কেই নারীরও যে পুরুষের সমান অধিকার পাওয়া উচিৎ সেই আলোচনা সামনে আনে। নারী দিবসেই এক বছরে নারীর সমঅধিকার অর্জনে সবার ভূমিকা ও পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করা যায়। তাই এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে নারী দিবস পালিত হলেও বিশ্বজুড়ে নারীর অবস্থানে খুব একটা তারতম্য চোখে পড়েনা। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও সহিংসতা এখনও বিদ্যমান। একখনও কর্মক্ষেত্রে বেতন এবং পদবীর ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করেন না। এদেশে এখনও একটা মেয়েকে নিজের স্বপ্ন পূরণের চাইতে সমাজের চাহিদা আগে মাথায় রাখতে হয়। অনেকেই উচ্চ শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত হন। বিয়ে এবং সন্তান ধারণের জন্য কেরিয়ার এবং পড়াশোনায় পিছিয়ে যান অনেকেই। অনেকসময় বাধ্য হন চাকরি ছাড়তে। এখনও সমাজের সব শ্রেণীর শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব ধরণের নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন।
এমন প্রেক্ষাপটে এখনও নারী দিবস প্রাসঙ্গিক হলেও অদূর ভবিষ্যতে দিনটির প্রয়োজনীয়তা থাকবে কিনা জানতে চাইলে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা কোনদিনই শেষ হবেনা। নারীরা যুগের পর যুগ ধরে যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তা মনে করানোর জন্য হলেও নারী দিবস উদযাপিত হবে ও হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এখনও একটা মেয়ে রাতে একা চলাফেরা করতে পারেননা নিরাপত্তার অভাবে। এসব নিয়ে কথা বলার জন্যও এমন একটা দিবস ভূমিকা রাখে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ও নারী নেত্রী আয়েশা খানম বলেন, নারী দিবস নারীর সামাজিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাই মিলে একসাথে কাজ করার শপথ নেওয়ার দিন। এই দিনে নারী উন্নয়নে নেওয়া বছরব্যাপি কর্মসূচি পর্যালোচনা করার দিন। এই দিন নারীর অর্জন নিয়ে উৎসবের আর নারীর বিরুদ্ধে হওয়া সমস্ত অন্যায় প্রতিরোধের।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়ার পরে এখন বিশ্বের ১৮৯ টি দেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী দিবস উদযাপন করা হয়। নারী উন্নয়নের নানা কর্মসূচি গ্রহন করা হয়। তাই তিনি মনে করেন, নারীর অধিকার আদায়ে নারী দিবসের ভূমিকা অপরিসীম।
আয়েশা খানম আরও বলেন, নারী শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মপরিবেশে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যমে নারী দিবস উদযাপন শুরু হয়েছিল। এখনও নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এখনও একজন কর্মজীবী মায়ের সন্তান মা যখন কাজ করবে তখন কোথায় নিরাপদ থাকবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নারীরা অনেকটা এগিয়ে এলেও এখনও অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে তাই নারী দিবসের গুরুত্ব কখনোই কমার নয় বলে মনে করেন তিনি।
অদূর ভবিষ্যতেও নারী দিবসের গুরুত্ব কমবে না বলেই মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার গৃহীত ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নে নারী-পুরুষের সমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই অদূর ভবিষ্যতে নারীর অবস্থান পর্যালোচনা করার জন্য নারী দিবসের গুরুত্ব বাড়বে বৈ কমবে না।
রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনও নানাভাবেই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর নারী। নারী দিবস নারীর অর্জন, প্রতিবাদ আর প্রাপ্তির কথা বলে। তাই নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতাও কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে।
ফিচার ফটো: ড. সঙ্গীতা তুলি
সূত্র : সারাবাংলা